কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০৬:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দালালমুক্ত কৃষিঋণ বিতরণে কঠোর নজরদারি দরকার : গভর্নর

ড. আহসান এইচ মনসুর। ছবি : কালবেলা
ড. আহসান এইচ মনসুর। ছবি : কালবেলা

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, কৃষকদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে কৃষিঋণ বিতরণে দালালমুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়াতে ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে কৃষকদের পর্যাপ্ত সহায়তা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন অর্থবছর ২০২৫-২৬-এর জন্য কৃষি ও পল্লি ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি ঘোষণা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন গভর্নর। অনুষ্ঠানে ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

গভর্নর বলেছেন, বাংলাদেশের কৃষকরা এখনও ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছেন না। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হলে কৃষকদের সহায়তা বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এজন্য তাদের ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ ও সরল করা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকের ‘এক্সেস টু ক্রেডিট’ বা ঋণে প্রবেশাধিকার নেই, বা থাকলেও তা খুবই সীমিত।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, ব্যাংকের মাধ্যমে যে কৃষি ঋণ বিতরণ হয়, তার সবটা কি প্রকৃত কৃষকের হাতে পৌঁছায়? এ বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। তাই আমরা বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। দালালের মাধ্যমে ঋণ যেন না যায়, সে বিষয়ে কড়া নজরদারি বাড়াতে হবে।

গভর্নর জানান, চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লিখাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের তুলনায় ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য ১৩ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের জন্য ২৫ হাজার ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত উচ্চাভিলাষী। অল্প টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরে শতভাগ পূরণের চেয়ে বড় লক্ষ্যমাত্রা ধরে এই খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোই ভালো। কারণ কৃষি শুধু কৃষকের জীবিকা নয়, পুরো জাতির খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ বছরের নীতিমালায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ খাতে বরাদ্দ ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। সেচ ও কৃষিযন্ত্রপাতি খাতে ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণে সিআইবি সার্ভিস চার্জ মওকুফ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতা বাড়ানো হবে, যাতে প্রান্তিক কৃষকরাও সহজে ঋণ পান। পাশাপাশি নতুন কিছু ফসল- যেমন খিরা, কচুর লতি, বিটরুট, কালোজিরা, আদা, রসুন, হলুদ ও খেজুর গুড়- কৃষি ঋণের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন সম্ভাবনা অনুযায়ী ঋণ বিতরণেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গভর্নর তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক কৃষক যখন বীজ, সার, কীটনাশক, যন্ত্রপাতি বা সেচের খরচ মেটাতে ব্যাংক বা সরকারি উৎস থেকে ঋণ নিতে চান, তখন নানা বাধার মুখে পড়েন। জমির দলিল, জামিনদার বা জটিল কাগজপত্রের শর্ত পূরণ করতে না পারায় তাদের ঋণ আবেদন বাতিল হয়। ফলে তারা বাধ্য হয়ে স্থানীয় মহাজন বা মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেন, যা তাদের ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দেয়।

তিনি বলেন, আমরা চাই এই প্রক্রিয়া সহজ হোক। ব্যাংকের শাখা গ্রামীণ এলাকায় আরও প্রসারিত হোক। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সেবা যেন কৃষকরা ব্যবহার করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে হবে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা ছোট ছোট কৃষি উদ্যোক্তাদের কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে উদ্বুদ্ধ করুন। তাহলে সব উদ্যোক্তা লাভবান হতে পারবে এবং পুরো জাতি উপকৃত হবে। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তারা বড় খামারি বা শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। প্রয়োজনে আপনারা মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিন, তবে কৃষি ঋণের পরিধি অবশ্যই বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিতরণ হয়েছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৮ শতাংশ। যদিও আগের বছরের তুলনায় বিতরণের পরিমাণ বেড়েছে, তবুও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ইতিবাচক দিক হলো, কৃষিঋণ আদায়ের পরিমাণ এক বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। যেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের অনর্জিত অংশ কেটে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড’-এ জমা করা হবে। পরবর্তীতে এই তহবিল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। কৃষি ঋণ শতভাগ কৃষকের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে দালালমুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করবেন, তাদের পুরস্কৃত করা উচিত।

একই সঙ্গে কৃষি ঋণের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে ওয়েব-ভিত্তিক অ্যাগ্রি-ক্রেডিট এমআইএস সফটওয়্যার উদ্বোধন করা হয় অনুষ্ঠানে।

দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, এ প্রক্রিয়া চলমান, তবে আমানতকারীদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। সরকার তাদের সব দায়দায়িত্ব নেবে। পাশাপাশি তিনি সরকারের আমদানি নীতির সমালোচনা করে বলেন, বছরের শুরুতেই সঠিক নীতি নির্ধারণ না করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বর্তমানে নীতিগত ভুলের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, এ নীতিমালা কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও টেকসই অর্থনীতি গঠনে বড় ভূমিকা রাখবে। গভর্নরের ভাষায়, আমরা যদি সঠিকভাবে এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে শুধু কৃষক নয়, পুরো দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশ পেরিয়ে কানাডায় ‘নয়া মানুষ’

৩৩ ওষুধের দাম কমলো, ১১৬ কোটি টাকা সাশ্রয়

জিমে ১২ লাখ ডলার খরচ করে নিলেন ৩০০ বছরের মেম্বারশিপ, অতঃপর...

ইমিগ্রেশনের ‘অনিয়মের’ সংবাদ প্রকাশের জেরে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা

ডেঙ্গু আরও ১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৩২৫ 

চ্যাটজিপিটি-৫ নিয়ে বিতর্ক, নতুন মোডে আসছে ৩ পরিবর্তন

শতাধিক গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে উধাও সমিতি

হিমাগারে অস্ত্রের মুখে ডাকাতি, গ্রেপ্তার ২

সাগরে লঘুচাপ, ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত

সরকারকে এক মাসের আলটিমেটাম শিক্ষকদের

১০

কুয়েতে ১০ প্রবাসীর মৃত্যু

১১

নতুন গ্রাহকদের জন্য বিশাল ছাড় দিচ্ছে স্টারলিংক, পাবেন যেভাবে

১২

মাস্ক পরে নামাজ পড়া জায়েজ আছে?

১৩

ঘরের দরজা ভেঙে যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

১৪

টাইমস স্কয়ারে প্রথমবার হবে দুর্গাপূজা

১৫

স্বামীকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্স খাদে, স্ত্রীর মৃত্যু

১৬

বেকারি থেকে কেনা নাস্তায় মিলল সাপ

১৭

শেখ হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের তিন মামলায় বাদীদের সাক্ষ্য গ্রহণ

১৮

যতীন সরকার মারা গেছেন

১৯

জিএম কাদেরের সাংগঠনিক কার্যক্রমে বাধা নেই

২০
X