দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় ‘দারুল মাকান হাউজিং প্রকল্প’-এর নামে পরিচালিত আবাসন প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। প্লট কিনেও জমি বুঝে না পাওয়া, একই প্লট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি, অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়মে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন হাজারো ভুক্তভোগী।
শনিবার (১৭ মে) রাজধানীর বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দারুল মাকান হাউজিং প্রকল্পের ভুক্তভোগীরা প্রতারণা ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মাকান প্লট হোল্ডার সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সালাউদ্দিন। এ সময় অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলামসহ অন্য ভুক্তভোগী সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
মো. সালাউদ্দিন বলেন, দারুল মাকান গ্রুপের আওতায় মাকান মডেল টাউন, বাড্ডা মডেল, মুন সিটি, হাজারীবাগ মডেল টাউন ও মাকান রিভার ভিউ নামে প্রকল্প চালিয়ে বছরের পর বছর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই হাউজিং প্রকল্পের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. শাহজাহান (বর্তমানে কারাগারে) তার ছেলে, মেয়ে, মেয়ের জামাই, স্ত্রী, ভায়রা ও ভাই এবং ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অসাধু পরিচালক সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে প্লট বিক্রি, রেজিস্ট্রেশন, উন্নয়ন ও বাসস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রতিশ্রুতির কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।
তারা জানান, একই প্লট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকে যথাযথভাবে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করলেও জমি বুঝে পাননি বা জমিতে প্রবেশ করতে গেলে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এমনকি রেজিস্ট্রেশনের আগেই অনেকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অনুমোদন ও ছাড়পত্রের নামে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, জমির দাগ নম্বর ও অবস্থানে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে একজন ক্রেতা প্রকৃত জমি চিহ্নিত করতেই না পারেন। এ ছাড়া ভুয়া দলিল তৈরি করে প্রকল্প এলাকায় অতিরিক্ত জমি বিক্রির নজিরও রয়েছে। মৌলিক অবকাঠামো যেমন- রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদির কোনো উন্নয়ন না করেও এসব খাত দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কেউ কেউ ঘর নির্মাণ করতে গেলে তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিবাদ করায় অনেকে ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন।
আরও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ হচ্ছে, প্রকল্প এলাকার পরিকল্পিত রাস্তার জমিকে প্লট হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে, যা পুরোপুরি প্রতারণা। এমনকি যারা প্রতারণার প্রতিবাদ করেছেন বা আইনি অভিযোগ জানিয়েছেন, তাদেরও বিভিন্নভাবে হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে দারুল মাকান প্রকল্পে দুর্নীতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ভুক্তভোগীদের অনেকেই জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছিলেন। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি নিজের ঘর বানাবেন। কিন্তু এখন তারা নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে, আত্মহত্যার কথাও ভাবছেন।
ভুক্তভোগীরা দারুল মাকান হাউজিং প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতি ও প্রতারণার বিরুদ্ধে সরকারের কাছে কয়েকটি জোরালো দাবি তুলে ধরেছেন। তারা দ্রুত মো. শাহজাহান ও মোস্তফা মেম্বারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৃত জমির মালিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জমিতে বসবাস বা ঘর নির্মাণে সহায়তা প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থ পরিশোধ করেও যারা রেজিস্ট্রি পাননি, তাদের দ্রুত রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করার এবং যারা রেজিস্ট্রি পেয়েও জমি বুঝে পাননি, তাদের প্রকৃত প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা আত্মসাৎকৃত অর্থের নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি করেছেন। পাশাপাশি বাড্ডা মডেল টাউন ও অন্যান্য প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারে মগারদিয়া বাজারে একটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া প্রকল্পের সব দলিল, অনুমোদন ও মালিকানা যাচাই করে সঠিক আইনি ভিত্তিতে প্রকল্পগুলো পুনর্গঠনের অনুরোধ করা হয়েছে।
সবশেষে, সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে তারা বলেন, এই ভয়াবহ প্রতারণা ও দুর্নীতির চক্র ভেঙে একটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। যেন সাধারণ মানুষের সঞ্চিত অর্থ ও আবাসনের স্বপ্ন ধ্বংস না হয় এবং ভুক্তভোগীরা ফিরে পান তাদের ন্যায্য অধিকার ও মানবিক সুবিচার।
মন্তব্য করুন