দীর্ঘদিনের শত্রুতা ও মতাদর্শগত বিরোধ ভুলে তালিবানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ শুরু করেছে ভারত। প্রশ্ন উঠেছে- কেন এখন? উত্তরটা ভূরাজনীতির এক জটিল খেলায়, যেখানে শত্রুর শত্রু হয়ে ওঠে বন্ধু।
২০২১ সালের আগস্টে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর এটিই প্রথমবার, যখন নয়াদিল্লি ও কাবুলের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ে প্রকাশ্য যোগাযোগ হলো। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর সম্প্রতি আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে কথা বলেছেন। জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানোর জন্য জয়শঙ্কর তাকে ধন্যবাদ জানান- যে হামলায় ২৬ জন নিহত হয়।
এই ফোনালাপের একদিন পর ভারতের কর্মকর্তারা জানান, তারা আফগানিস্তান নিয়ে সাহসী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে এবং তালিবান-শাসিত রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে। এর মধ্যে মানবিক সহায়তা থেকে শুরু করে আফগান শরণার্থীদের সাহায্য করাও অন্তর্ভুক্ত।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে- যে তালিবান একসময় ভারতের চরম বিরোধী ছিল, তাদের দিকেই এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছে নয়াদিল্লি কেন?
এর উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বহু পুরোনো- ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির স্তরে স্তরে এই সম্পর্কের ছাপ রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য ‘মহাভারতে’ দেখা যায় গান্ধার রাজ্য, যা বর্তমান আফগানিস্তানের কান্দাহারের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। শকুনি, যিনি ছিলেন মহাভারতের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী, তিনি গান্ধারের রাজপুত্র ছিলেন।
ঐতিহাসিকভাবে, মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকে শুরু করে ব্রিটিশ উপনিবেশ যুগ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ছিল জটিল কিন্তু নিবিড় সম্পর্ক। ১৮ শতকে দুররানি সাম্রাজ্যের সময় দুই অঞ্চলের চূড়ান্ত বিভাজন হয়। পরে ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে রাশিয়ার সঙ্গে ‘গ্রেট গেম’-এর অংশ হিসেবে বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার করে।
ভারত ১৯৭৩ সালে আফগানিস্তানকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তালিবানের উত্থানের পর ভারতের অবস্থান পুরোপুরি বদলে যায়। কারণ, তালিবানকে পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় গড়া একটি চরমপন্থি গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করত নয়াদিল্লি।
১৯৯৯ সালের কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের অন্যতম নিম্নতম স্তর। কাঠমান্ডু থেকে ছিনতাই হওয়া বিমানটি তালিবানের নিয়ন্ত্রিত কান্দাহারে নামানো হয় এবং ভারতকে অপহরণকারীদের দাবি মেনে জঙ্গি মুক্তি দিতে বাধ্য করা হয়।
২০২১ সালে তালিবান আবারও কাবুলের ক্ষমতায় ফেরার পর ভারত প্রথমে সতর্ক অবস্থান নেয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত রেখে তারা আফগানিস্তানে সীমিত মানবিক সহায়তা প্রদান করে। তবে সেই ‘ধীরে চলো’ নীতির ছায়া এখন কেটে যাচ্ছে।
২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর জয়শঙ্করের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়- ভারত এখন আর পেছনের দরজায় নয়, প্রকাশ্যে তালিবানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে হাঁটছে।
এই ঘনিষ্ঠতার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক কারণ হলো পাকিস্তান ও তালিবান সরকারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা। একসময় তালিবানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু এখন তালিবান-শাসিত আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা, শরণার্থী ইস্যু, ও টিটিপি-র হামলা নিয়ে দ্বন্দ্ব তুঙ্গে।
পাকিস্তান অভিযোগ করছে, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সদস্যরা আফগান ভূমি ব্যবহার করে তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এমনই এক হামলার জেরে পাকিস্তান আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলা চালায়।
এই প্রেক্ষাপটে তালিবান-ভারত সম্পর্ক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে। কূটনীতিতে একটা পুরোনো প্রবাদ আছে- কোনো দেশের স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, আছে শুধু স্থায়ী স্বার্থ।
তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তানের টানাপোড়েনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৌশলগতভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে ভারত। তালিবানও পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্বের কারণে ভারতের মতো বিকল্প শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী।
তালিবানের ইতিহাস বলছে, তারা দীর্ঘমেয়াদে কারও সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না। একসময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র ছিল, পরে সেই যুক্তরাষ্ট্রই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়। এখন পাকিস্তানের সঙ্গেও সেই একই পথেই হাঁটছে তারা।
তালিবান সরকারের অস্থির ভবিষ্যৎ ও আফগানিস্তানের নিরাপত্তা জটিলতা সত্ত্বেও ভারত কৌশলগত দিক থেকে এখন তালিবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাকেই ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে। এই ঘনিষ্ঠতা শুধু কাবুল নয়, ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের দিকেও একটি বার্তা- দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে নয়াদিল্লিও এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
আফগানিস্তানের দিকে ভারতের বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, বর্তমান কূটনৈতিক সুযোগ এবং ভবিষ্যতের কৌশলগত স্বার্থ। তালিবান যদিও বিশ্ব রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার প্রতীক, তবুও ভূরাজনৈতিক দাবা খেলায় কখনো কখনো আশ্চর্য চালও দিতে হয়- এটি তেমনই এক পদক্ষেপ।
সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে
মন্তব্য করুন