কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ১০৮৫ হেক্টর জমিতে থাকা ১ হাজার ৮৪০টি পুকুর ও খামারে চাষকৃত বিভিন্ন প্রজাতির ৩ হাজার ৭০০ টন মাছ ভেসে গেছে। যার আনুমানিক মূল্য ১১১ কোটি টাকা বলে উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন ঘুরে বিভিন্ন মৎস্য চাষিদের সঙ্গে কথা হলে তাদের হতাশার চিত্র তুলে ধরে হতাশার কথা জানান।
হাউমাউ করে কান্নাকণ্ঠে দক্ষিণ কুমিল্লার বড় মৎস্য চাষি চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মুন্সীরহাট ইউনিয়নের বাহেরগড়া গ্রামের পাটোয়ারী বহুমুখী অ্যাগ্রো ফিসারিজ মালিক বায়জিদ হোসেন কালবেলাকে জানান, বন্যায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। চোখের পলকে সাড়ে ১০ কোটি টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে যায়। আমার দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত মাছের খামার নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। আমার আর কিছুই রইল না। পথে বসে গেলাম। ব্যাংক ঋণ, কর্মচারীদের বেতন, ফিড ওষুধ কোম্পানির বকেয়া টাকা কিভাবে পরিশোধ করব জানি না।
তিনি জানান, ব্যাংক লোন, আত্মীয়স্বজন থেকে ধার নিয়ে ও নিজের কাছে যা ছিল সবকিছুই খামারে বিনিয়োগ করেছি। প্রায় ২৪০ একর জায়গায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন করে আসছি। আলহামদুলিল্লাহ ভালোভাবে আমার ব্যবসা চলছিল। বন্যার আগে কোটি টাকার মালিক ছিলাম, আর এখন আমি দেনাদার।
চিওড়া ইউনিয়নের ফয়সাল মৎস্য অ্যান্ড ফিস প্রজেক্ট মালিক ফয়সাল হোসেন জানান, ৪৫ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ৬৭ একর জলাশয়জুড়ে মৎস্য প্রজেক্ট শুরু করি। আমার এই প্রজেক্টে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল। বন্যার পানি আমার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ব্যাংক ঋণ, ফিড বকেয়া ও কর্মচারীর বেতন কীভাবে পরিশোধ করব জানি না। তাই সরকারের কাছে সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি।
চৌদ্দগ্রামকে এম ফিশারিজের মালিক ইঞ্জিনিয়ার সাইদুর রহমান শামীম জানান, ছাত্রজীবন থেকে বড় ভাই খোরশেদ আলমের পরামর্শে ১৯৮৬ সালে মাছ উৎপাদনে জড়িত, ২২ একর জলাশয়ে প্রায় তিন কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল। আমাদের জীবনে এই ধরনের ফ্লাড (বন্যা) কোনোদিন দেখিনি কেউ, অতিবৃষ্টি ও ভারতীয় পানির আগ্রাসনে আমাদের প্রতিটি প্রজেক্ট থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে যায়। ২০ আগস্ট এর আগেও আমরা কোটি টাকার মালিক ছিলাম। পরের দিন সকালে নিঃস্ব হয়ে গেলাম, তিন কোটি টাকা ব্যাংকঋণ, ফিড, ওষুধ কোম্পানির এবং কর্মচারীর বেতন কীভাবে পরিশোধ করব জানি না। মৎস্য উপদেষ্টা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে এলে আমরা আবেদন করেছি আমাদের আর্থিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার জন্য।
মুন্সিরহাট ইউনিয়নের বারাইশ গ্রামের নোমান মৎস্য খামারে মালিক নোমান ভূঁইয়া জানান, ৩৫ একর জমিতে মাছ চাষ করেছি। আমার জীবনের সমস্ত কিছু ফিশারিতে বিনিয়োগ করেছি এখন আমার বলতে আর কিছুই রইল না। স্মরণকালের বন্যায় আমাকে পথে বসিয়ে দিল। পাওনাদারের ভয়ে আজ বাড়িতে এক প্রকার বন্দি হয়ে আছি। এ সময় সরকার আমাদেরকে সহায়তা না করলে আমরা কীভাবে বাঁচব।
একই গ্রামের শহিদুল হক জানান, ২০ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের রুই, কাতল, তেলাপিয়া, পাঙাশ মাছ চাষ করে আসছি। বন্যার পানিতে আমার ৭০ লাখ টাকার মাছ ভেসে যায়।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শেফাউল আলম জানান, বন্যায় চৌদ্দগ্রামে মৎস্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা, সচিব ও মহাপরিচালক চৌদ্দগ্রাম পরিদর্শন করেছেন। ওই সময় আমরা প্রস্তাব করেছিলাম ব্যাংক লোন ছয় মাস থেকে এক বছর না নেওয়া হয়, এবং স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মৎস্য চাষে উপকরণ দ্রুত সময়ে দেওয়া হয় যাতে করে তারা আবারও মাছ চাষে মনোযোগী হতে পারে।
মন্তব্য করুন