বশির হোসেন, খুলনা
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বিনা পারিশ্রমিকে ৫০০ কবর খুঁড়েছেন তৈয়বুর

কালবেলার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সম্মাননা পুরস্কার নেন মো. তৈয়বুর রহমান। ছবি : কালবেলা
কালবেলার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সম্মাননা পুরস্কার নেন মো. তৈয়বুর রহমান। ছবি : কালবেলা

নিজের মহল্লা ও আশপাশের এলাকায় দিন বা রাতের যে কোনো সময় মানুষের মৃত্যুর খবর শুনলে ছুটে যান তিনি। গিয়ে মরদেহের মাপ নেন, এরপর শুরু করেন কবর খোঁড়া। তবে এ কাজে তিনি কোনো পারিশ্রমিক নেন না। কবর খোঁড়াই যেন তার কাছে নেশা। গত ২৫ বছরে পাঁচ শতাধিক কবর খুঁড়েছেন তিনি।

এমন মানবিক কাজ করে এলাকায় প্রশংসা কুড়িয়েছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মহেশ্বরপাশা খানাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. তৈয়বুর রহমান।

তৈয়বুর রহমান একই এলাকার মো. আবুল হাসেম খানের ছেলে। নিজেও দুই সন্তানের জনক। ছোটবেলায় তার বাবা মারা যাওয়ায় বাবার স্মৃতি মনে নেই। তবে মায়ের কাছে তার বাবার সমাজসেবামূলক কাজ এবং মৃত মানুষের জন্য কবর খোঁড়া ও গোসল করানোর কথা শুনেছেন। তার বাবা মারা যান ১৯৮১ সালে। বাবার তৈরি বাড়িতে একটি ছোট ঘরে বসবাস করেন।

ছোটবেলায় এলাকার মুরব্বিদের সঙ্গে কবরস্থানে যেতেন তিনি। কখনো পাশে দাঁড়িয়ে দেখতেন, কখনো কোদাল বা মাটির ঝুড়ি এগিয়ে দিতেন। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি নিজে কবর খোঁড়ার দায়িত্ব নেন। সেই থেকে গত ২৫ বছরের বেশি সময় অন্তত ৫০০ কবর খুঁড়েছেন তিনি।

তৈয়বুর পেশায় একটি সরকারি হাইস্কুলের অফিস সহায়ক। তবু এ কাজ করতে তার কোনো সমস্যা হয় না। সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োগ রাখেন বলে কবর খুঁড়ে কোনো পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেন না তিনি।

জানা যায়, তৈয়বুর খুলনা শহরের কেসিসি এক ও তিন নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে ফুলবাড়িগেট, মহেশ্বর পাশা, কালীবাড়ি, যোগীপোল, দিঘিরপাড়, খানাবাড়ি, রেলিগেট, এমনকি দৌলতপুর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে মৃত ব্যক্তির কবর খুঁড়েছেন। বিশেষ করে প্রাণঘাতী করোনা মহামারির সময় তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে নিজের পুরো খুলনায়। লকডাউন চলাকালীন যখন কেউ কারও কাছে যেতে ভয় পেত, তখন তিনি একাই এগিয়ে যান করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিতের কবর খোঁড়া, গোসল করানো এবং দাফনের কাজে।

এ সময় খুলনার রূপসা তেরখাদাসহ বিভিন্ন উপজেলায় করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির গোসল ও দাফনের জন্যও তাকে ডাকা হতো। করোনায় নিজে আক্রান্ত হওয়ার ভয় না পেয়ে মানবিকতা দেখিয়ে সবার দোয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি।

তৈয়বুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমার বাবা ১৯৬৫ সালে খুলনা আসেন। তখন থেকে এলাকার মৃত ব্যক্তিদের কবর খোঁড়ার কাজ করে দিতেন তিনি। আমিও তাকে সাহায্য করতাম। এরপর বাবা মারা গেলে ১৯৯৫ সাল থেকে আমিই মানুষের কবর খুঁড়ে দিই। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে খানাবাড়ি, মহেশ্বরপাশাসহ আশপাশের এলাকার মানুষ মারা গেলেই আমাকে খবর দিত। কোনো বাধা আমাকে দমাতে পারেনি। এ কাজ করতে গিয়ে আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমি সরকারি স্কুলে কাজ করি। কখনো যদি কোনো মৃত্যুর খবর পেয়েছি। প্রধান শিক্ষককে জানালে তিনি আমাকে সব সময় ছুটি দিতেন। আমি এটিকে সামাজিক ও ইসলামিক কাজ হিসেবে মনে করি। মানুষ খুব প্রশংসা করে। আল্লাহও পছন্দ করেন, তাই এই কাজ করি। বিশেষ করে করোনাকালে সবাই যখন ভয়ে মরদেহ থেকে দূরে চলে যেত, আমি সাহস নিয়ে আক্রান্তসহ নানা রোগে মৃত ব্যক্তিদের কবর দিয়েছি। এ কাজে আমি টাকাপয়সার লোভ করিনি।

তৈয়বুর বলেন, অনেক মানুষ টাকা-পয়সা দিতে চায়। আমি নিই না। তবে কয়েকজনের কাছ থেকে কবর খোঁড়ার সরঞ্জাম কোদাল, কুড়াল, বালতি নিয়েছি। আমি মসজিদে জুমার নামাজের আগে ইমাম সাহেবকে দিয়ে অনেকবার বলিয়েছি যে কবর খোঁড়ার বিনিময়ে আমাকে কেউ কিছু দিতে পারবে না। এমনকি খুশি হয়ে দিলেও না। আল্লাহ যদি দেন আখিরাতে কিছু পাব।

আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কিছু পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে গত ১৬ অক্টোবর, এমনটা উল্লেখ করে তৈয়বুর বলেন, ১৬ অক্টোবর কালবেলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাকে ক্রেস্ট দিয়ে সম্মানিত করেছে তারা। আমার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে। ডিসি ও ডিআইজি স্যার আমাকে ক্রেস্ট দিয়েছেন। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। ওই দিনই আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। আমি যে স্কুলে চাকরি করি, সেদিন আমার স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গোলাম আজম স্যার আমাকে বলেন যে বাবা তুই আমার কবর খোঁড়ার দায়িত্ব নিস। তোর এই কাজে আমরাও সম্মানিত বোধ করি। সেদিনও আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন।

দুই বছর আগে থেকে তৈয়বুরের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হাসান। ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও তৈয়বুর যখন যেভাবে ডাকেন, তিনি চলে আসেন মানবতার সেবায়।

হাসান কালবেলাকে বলেন, আমি ভ্যান চালিয়ে খাই। কিন্তু তৈয়বুর ভাই অনেক বছর আগে থেকে এই সেবা করে, আমিও তার দেখাদেখি উদ্বুদ্ধ হয়েছি। এখন তার সঙ্গে কবর খুঁড়তে যাই। মানুষ খুব প্রশংসা করে, ভালোবাসে, এটা দেখে ভালো লাগে। আমরা কারও কাছ থেকে এক কাপ চা-ও খাই না এ কাজের বিনিময়ে। তৈয়বুরের কাজে এখন এলাকার বেশ কয়েকজন এগিয়ে এসেছেন বলেও জানান তিনি।

আমজিয়ার রহমান নামে এক ব্যবসায়ী কালবেলাকে বলেন, লিটনকে (তৈয়বুরের ডাকনাম) আমি স্কুলজীবন থেকে চিনি। তখন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কাজে জড়িত ছিল সে। ছোটবেলা থেকেই মৃত মানুষের কবর খোঁড়ার মতো মহৎ কাজ করে সে। এই এলাকায় যত মানুষ মারা যায়, মসজিদে মাইকে ঘোষণা হলে মৃত মানুষের পারিবারিকভাবে তাকে খবর দেয়। সে নিজেও এগিয়ে যায় এ কাজে। তাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। তার মতো ছেলে এলাকায় আরও দরকার।

তৈয়বুর রহমানের টিমে মাঝেমধ্যেই মৃত মানুষের গোসল করান মো. আবু হানিফ। তিনি বলেন, তৈয়বুর রহমান ২৫ বছর ধরে এই কাজ করেন। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত। কারণ, তিনি যে কাজ করেন, এটা মানিবক কাজ। এই এলাকায় কোনো মানুষ মারা গেলে এখন আমিও গোসলের কাজ করি। বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক নিই না। আল্লাহকে খুশি করার জন্য আমরা এই কাজ করি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাদাগিরি করতে গিয়ে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত : মুরাদ

বগুড়ায় ডা. জুবাইদার লেখা বই বিতরণ ও ফ্রি হৃদরোগ চিকিৎসা ক্যাম্প

হৃদরোগীদের জন্য ডা. জোবায়দা রহমানের পরামর্শমূলক বই বিতরণ উদ্বোধন

মাহমুদউল্লাহ পারেন কিন্তু বাকিরা…

ফ্যাসিবাদের হোতা আ.লীগের বিচার হবেই হবে : প্রিন্স

ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ২৪১

কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক

২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন করা যেতে পারে : জামায়াত সেক্রেটারি

দুঃসংবাদ দিল তিতাস গ্যাস

যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘বুদ্ধিজীবী দিবস’ ও ‘বিজয় দিবস’ পালনের আহ্বান ডা. শফিকুর রহমানের

১০

কুড়িগ্রামের উলিপুর সীমান্তে ২ পাচারকারী আটক

১১

ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব; গ্রেপ্তার সাকিবদের মালিক

১২

মার্কিন উপকূলে ইরানের যুদ্ধজাহাজ, আকাশে উড়ছে ড্রোন!

১৩

নারী ফুটবল র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭ ধাপ উন্নতি বাংলাদেশের

১৪

বোমা মেরে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি

১৫

জিএমপির ডিসি কার্যালয়ের সামনে জুবায়েরপন্থিদের বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি প্রদান

১৬

আ.লীগের চরিত্র বদলায়নি : জামায়াত আমির

১৭

২৫ মার্চ কালরাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন কবি হেলাল হাফিজ

১৮

বাকৃবিতে জাতীয় ভাষা উৎসব শুরু

১৯

চাল কিনতে বাড়ি থেকে বের হন দুই বোন, অতঃপর...

২০
X