দু’চোখে আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণের হাতছানি এখন টানাপোড়েনের সংসারে অভাব ঘোচাতে শুরু করল চৌদ্দগ্রামের রাফির। অর্থাভাব ও ভাঙাচোরা ঘরে থেকেই কোনো রকম এসএসসি পাস করার পর একটি সরকারি চাকরির জন্য বিভিন্ন বাহিনীতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এরইমধ্যে তার কৃষক বাবা মকবুল আহমেদ স্ট্রোক করায় সংসারে শুরু হয় অভাব-অনটন। তবে সব বাধা পেরিয়ে এবার রাফির লালিত স্বপ্ন সত্যি হয়েছে মাত্র ১২০ টাকায়।
অভাব-অনাটনে থেকে ভাগ্য পরিবর্তন করা সাজ্জাতুল ইসলাম রাফি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা। রাফি যেই ঘরে থাকেন সেটি তিন রুমের দোচালা ভাঙাচোরা ঘর। বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাইরের সূর্যের আলো দেখা যায়। বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির পানি ঘরে প্রবেশ করে। অভাবের সংসারে পড়ার টেবিলে বসে পড়ার জন্য নেই চেয়ার। ছোট নাল টুলে বসে চলছে রাফির পড়ালেখা। টেবিলের ওপর পড়ে আছে সেনা, নৌ, পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগের বিভিন্ন বই। নিজ সফলতার পূর্ণ কৃতিত্ব দেন মামা ও খালাদের। তাদের অনুপ্রেরণা ও আর্থিক সহযোগিতায় বারবার অকৃতকার্য হওয়ার পর সফল হওয়া রাফি নিজেকে উৎসর্গ করতে চান দেশ ও দেশের মানুষের সেবায়।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার লক্ষ্যে এসএসসি পাস করার পর থেকে আবেদন শুরু করেন বিভিন্ন বাহিনীতে। একাধারে করেছেন নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ব্যাটালিয়ন ও আনসারে। অবশেষে ২০২৫-এ ১২০ টাকায় ঘুষ বাণিজ্য ছাড়া ১২০ টাকায় পুলিশে নিয়োগ পায় রাফি। চলতি বছর রয়েছে আনসার ব্যাটালিয়ন ও বিজিবির নিয়োগ পরীক্ষা।
অদম্য রাফির বাবা মকবুল আহমদ বলেন, ৫ বছরের সাধনায় সে সফল হয়েছে। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই সে যেন দেশের জন্য কাজ করতে পারে।
রাফির মা বলেন, আমি গর্বিত, ঘুষ ছাড়া নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে আমার ছেলে। এ জন্য আমি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।
রাফির গৃহশিক্ষক বলেন, ছোটবেলা থেকে তার একটা স্বপ্ন ছিল সে দেশের সেবা করবে, সেই প্রচেষ্টাস্বরূপ সে ২০২৫ এ বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি পেয়েছে। এ জন্য ওর গৃহশিক্ষক হিসেবে আমি গর্বিত।
প্রবাস থেকে মামা মহিন উদ্দিন বলেন, আমার ভাগিনার পড়ালেখার আগ্রহ দেখে আমি সব সময় ভাগিনার খোঁজখবর রাখতাম, পড়ালেখার কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা কোন ঘাটতি আছে কিনা সকল বিষয় ভাগিনার সঙ্গে শেয়ার করতাম। ভাগিনা রাফি নিজ যোগ্যতায় পুলিশের চাকরি পেয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
সদ্য পুলিশে চাকরি পাওয়া সাজ্জাতুল ইসলাম রাফি বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ডিফেন্সের যে কোনো বাহিনীতে যোগ দেওয়া। সে লক্ষ্যে এসএসসি পাসে পর ২০২১ সালে সেনাবাহিনী-নৌবাহিনীতে আবেদন করি। উচ্চতার জন্য সেখানে বাদ পড়ি। এরপর আমি নিজের উচ্চতা বাড়াতে ব্যায়াম শুরু করি। অকৃতকার্য হই পুলিশ, আনসার ব্যাটালিয়ন ও আনসারে।
তিনি আরও বলেন, আমার মামারা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন, অর্থ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে পাশে থেকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। নিয়োগ পরীক্ষায় যাওয়ার আগেই মামারা নতুন শার্ট প্যান্ট কিনে দিতেন। পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি আসা পর্যন্ত মামারা প্রবাস থেকে খবর রাখতেন বাড়িতে ফিরছে কিনা। অবশেষে পুলিশে কৃতকার্য হই। এর জন্য আমি মামা খালা ও আত্মীয়স্বজনের নিকট কৃতজ্ঞ। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, আমি যেন দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করতে পারি।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে) বিকেল সাড়ে ৪টায় পুলিশ লাইনের শহীদ আর, আই.এ.বি.এম আব্দুল হালিম মিলনায়তনে ফলাফল ঘোষণা করেন জেলা পুলিশ সুপার মো. নাজির আহমেদ খান। কুমিল্লায় ১২০ টাকায় কনস্টেবল পদে চাকরি পেলেন ৭৫ জন। এর মধ্যে ৭০ জন ছেলেও ৫ জন মেয়ে চাকরি পেয়েছেন।
গত ৪ এপ্রিল এ নিয়োগ পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়। এ নিয়োগ পরীক্ষায় ১ হাজার ৩৫১ জন আবেদন করেন। মাঠের পরীক্ষা শেষে ৬৯০ জন উত্তীর্ণ হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষা শেষে এ সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ২৩৯ জনে। সব পরীক্ষা শেষে ৭৫ জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়। অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে ১৫ জনকে।
ফলাফল ঘোষণা শেষে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান বলেন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধার ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিদের আমরা প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করেছি।
মন্তব্য করুন