তিন মাস বন্ধ থাকার পর রাত পোহালেই ১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য যাবেন জেলেরা। তাই সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার ঘরে ঘরে এখন ঈদ আনন্দ।
তিন মাসের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন স্বপ্ন বুনছেন তারা। সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য নৌকা প্রস্তুত করেছেন উপকূলীয় এলাকার জেলেরা। শেষ মুহূর্তের ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। নৌকা মেরামত ও রঙের কাজ চলছে পুরোদমে। মেরামত করা হচ্ছে মাছ ধরার জাল।
তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর তারা জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন। সাময়িক বেকারত্বের অবসান হওয়ায় জেলে, বাওয়ালি ও ট্রলারচালকদের মধ্যে খুশির আমেজ বিরাজ করছে।
পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, জীবজন্তু ও মাছের প্রজনন বাড়ানোর জন্য ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে ৯২ দিনের জন্য নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশেরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আগামী ১ সেপ্টেম্বর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন বুড়িগোয়ালিনি চুনো নদের পাড়ে গিয়ে দেখা গেল, নৌকায় আলকাতরা দিচ্ছেন আসাদুজ্জামান গাজী (৪৪)। তিনি জানান, সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরেই পাঁচ সদস্যের সংসার চালান। এলাকায় অন্য কোনো কাজ নেই। মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ করে দিলে বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হয়। গত তিন মাস সংসার চালাতে বেসরকারি সংস্থা আর মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে মাছ ও কাঁকড়া ধরে ঋণ পরিশোধের আশা তার।
শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন দাতিনাখালী গ্রামের জেলে আবদুল হাকিম গাজী (৬৫)। তিনি ৫০ বছর ধরে সুন্দরবনে যাচ্ছেন। আগে বাবার সঙ্গে যেতেন। এখন অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে যান। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল তার জীবন-জীবিকা। আবদুল হাকিম গাজী বলেন, এই তিন মাস সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা বেকার থাকেন। তাদের জন্য কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না। তিনি বেসরকারি সংস্থা ও মহাজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরে এসব ঋণ পরিশোধ করবেন। ইতোমধ্যে নৌকা মেরামত ও রং করেছেন। জাল মেরামত করে এখন শুধু সুন্দরবনে ঢোকার জন্য অপেক্ষা। আগেভাগে সুন্দরবনে ঢুকতে পারলে মাছ বেশি পাওয়া যেতে পেরে, এ আশায় প্রথম দিনেই (১ সেপ্টেম্বর) তিনি যাবেন।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, ১ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশন থেকে নৌকা নিবন্ধন (বিএলসি) হয়েছে ২ হাজার ৮৩৯টি। বুড়িগোয়ালিনি স্টেশন কর্মকর্তা নূরুল আলম জানান, সাধারণত একটি নৌকায় ৫-৬ জন করে মাছ কিংবা কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনে ঢুকে থাকেন।
সুন্দরবন ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হালিম জানান, পর্যটকের ওপর নির্ভর করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় পাঁচ শতাধিক ট্রলার চলে। সুন্দরবনে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখার পাশাপাশি পর্যটক ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় তাদের প্রায় দেড় হাজার ট্রলারচালক ও শ্রমিক বেকার জীবনযাপন করেন। তাদের সংসার চলে খুব কষ্টে ধারদেনা করে।
সুন্দরবন জেলে বাওয়ালি মৌয়াল সমিতির সভাপতি সুশান্ত মণ্ডল বলেন, বছরের প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সুন্দরবনের মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকে। মৎস্য বিভাগ প্রতি বছর মাছের প্রজনন রক্ষায় ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রাখে। এই অবসরকালে সাগরে মাছ ধরা ওই জেলেদের মাথাপিছু ৮৬ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের জন্য কোনো সুবিধা কিংবা বরাদ্দ নেই। তিনি এ সময় বেকার হয়ে পড়া জেলে ও বাওয়ালিদের জন্য বরাদ্দের দাবি জানান।
সুন্দরবনের ডালে ডালে এখন পাখির কলরব, জলে জলে বন্য প্রাণীর অবাধ সাতার, মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করে দিলে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল সবার অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয় বলে জানালেন বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল ও গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাছুদুল আলম। তারা নিষেধাজ্ঞার সময় বনজীবীদের খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, তিন মাস পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলে ও বাওয়ালিদের সুন্দরবনে ঢোকার পাস (অনুমতি) দেওয়া হবে। এ জন্য আগে থেকে জেলে বাওয়ালির পাশাপাশি পর্যটক পরিবহনকারী ট্রলার মালিকরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সুন্দরবন সুরক্ষায় বন বিভাগ সব সময় প্রস্তুত আছে। সকল বনজীবীকে বনের আইন মেনে চলতে হবে।
মন্তব্য করুন