খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ১০:১০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সবুজে ঘেরা বিদ্যুৎকেন্দ্রে পাখির অভয়াশ্রম, খালে ডলফিন

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ছবি : কালবেলা
রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ছবি : কালবেলা

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন রূপ নিচ্ছে পরিবেশবান্ধব ও জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ একটি এলাকায়। কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো একটি ভারী শিল্প প্রকল্পের সঙ্গে কীভাবে প্রকৃতি, পাখি ও জলজ প্রাণী একত্রে সহাবস্থান করতে পারে- তার একটি বাস্তব উদাহরণ হয়ে উঠছে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প।

একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে পরিচালিত পরিবেশ সচেতন বিদ্যুৎ উৎপাদন, অন্যদিকে প্রকল্প এলাকা ও আশপাশে বিস্তৃত সবুজ বেষ্টনীতে পাখির কলকাকলি এবং খাল ও নদীতে খেলে বেড়ানো গাঙ্গেয় ডলফিন- সবমিলে এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য পরিবেশবান্ধব শিল্পের প্রতীক।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে গঠিত “বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)” পরিচালিত এই ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে সুন্দরবনের পশুর নদীসংলগ্ন রামপাল উপজেলার সীমানায়। শুরুতে এর অবস্থান ও প্রকৃতি ধ্বংসের আশঙ্কা নিয়ে দেশ-বিদেশের পরিবেশবাদীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের নানা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার কারণে চিত্রটি এখন অনেকটাই বদলে গেছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রামপাল পাওয়ার প্লান্টের চারপাশে কয়েক ধাপে মোট ৫ লাখ গাছ লাগানো হবে। ইতোমধ্যে ২ লাখ গাছ লাগানো হয়েছে। পরবর্তীতে বন বিভাগের সঙ্গে আবারও সমন্বয় করে ধারাবাহিকভাবে অবশিষ্ট ৩ লাখ গাছ রোপণ করা হবে।

রামপালের ৯১৫ একর প্রকল্প এলাকার মধ্যে প্রায় ৪০০ একর বনভূমি, যেখানে লাগানো হয়েছে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির কয়েক লাখ গাছ। গাছপালার এই ছায়াঘেরা পরিবেশে এখন বসবাস করছে নানা প্রজাতির পাখি। নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে ফিঙে, বাবুই, দোয়েল, বুলবুলি, টিয়া, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, শালিক, বক, কাক, কাঠঠোকরাসহ প্রায় ৪০টিরও বেশি পাখির প্রজাতি। শীত মৌসুমে দেখা যায় অতিথি পাখির আনাগোনা। তাদের অবাধ বিচরণ প্রমাণ করে, প্রকল্প এলাকাটি এখন পাখিদের জন্য একটি নিরাপদ অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও পশুর নদীতে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে গাঙ্গেয় ডলফিন, স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় শুশুক। ডলফিন সাধারণত দূষণমুক্ত ও শান্ত পরিবেশে বিচরণ করে। এদের উপস্থিতি বোঝায় যে জলজ বাস্তুতন্ত্র এখানকার পরিবেশে আবার সচল হয়ে উঠেছে।

জেলেরা জানান, আগে বছরে দু-একবার চোখে পড়লেও এখন নিয়মিতই তারা ডলফিন দেখতে পান। কখনো একা, আবার কখনো জোড়ায় বা দলবেঁধে তারা খেলে বেড়ায়। এই দৃশ্য শুধু স্থানীয়দের নয়, আগত দর্শনার্থীদের কাছেও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছে।

প্রকল্প পরিচালক রমানাথ পূজারী বলেন, শুরু থেকেই আমরা পরিবেশগত দায়বদ্ধতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত- যেখানে কার্বন নিঃসরণ, ছাই ব্যবস্থাপনা ও পানি শোধনের জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থা। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় প্রায় এক লাখ গাছ লাগানো হয়েছে এবং আমরা আরও সবুজায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি।

তিনি বলেন, পাখি, জলজ প্রাণী ও আশপাশের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় আমরা বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করছি। প্রকল্প এলাকা এখন একটি প্রাকৃতিক অভয়াশ্রমে রূপ নিচ্ছে, যা স্থানীয়দের জন্যও গর্বের বিষয়।

শুধু প্রকৃতি সংরক্ষণ নয়, প্রকল্প এলাকার মানুষদের নিয়েও কাজ করছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে প্রশিক্ষিত যুবকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিভাগে। তাদের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে নিয়মিত কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হচ্ছে।

ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) জি. এম. তরিকুল ইসলাম বলেন, আমরা শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করি না, আমরা সমাজ ও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান নিশ্চিত করার দিকেও গুরুত্ব দিই। স্থানীয় জনগণকে নিয়েই আমাদের এই প্রকল্পের উন্নয়ন চলছে। অনেক স্থানীয় যুবক আমাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এখানে কাজ করছেন। আমরা নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, যেন প্রকৃতি রক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একসঙ্গে সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, এই প্রকল্পে আমরা পরিবেশবান্ধব একটি কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেছি। শ্রমিকদের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি তাদের পরিবেশ সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সুন্দরবনের পাশে গড়ে ওঠা এই প্রকল্প যেন প্রকৃতির সুরক্ষার প্রতীক হয়, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।

এদিকে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য দীপংকর রায় বলেন, শিল্প ও প্রকৃতি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দুটিকে সমন্বয় করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। রামপাল প্রকল্প এখন সেদিকেই এগোচ্ছে। তার মতে, পরিবেশগত ঝুঁকি থাকলেও তা সঠিক ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, আর রামপাল প্রকল্প এখন তার বাস্তব প্রমাণ।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকেও প্রকল্পটির প্রতি একটি আস্থা তৈরি হয়েছে। পাশের গ্রাম তাপসীপুরের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, প্রথমে আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের এলাকার পরিবেশও বদলে দিয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে পাথর লুটপাটকারীদের নিয়ে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে দুদক

প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দে মন্ত্রী-সচিবসহ যাদের কোটা বাতিল

১১ বছর আগে মারা যাওয়া স্বামীই সন্তানের বাবা, দাবি অন্তঃসত্ত্বার

ডাকসু নির্বাচন / দ্বিতীয় দিনে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন ১৩ জন

জরায়ুর বদলে লিভারে বেড়ে উঠছে ভ্রূণ, বিস্মিত চিকিৎসকরাও

ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না : অর্থ উপদেষ্টা

মোদির হাতেই দেশ নিরাপদ, বললেন কংগ্রেস নেতা

অসহায় বিধবা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিলেন তারেক রহমান

এবার জাফলংয়ে পাথর লুটপাট বন্ধে অভিযান

ইবতেদায়ি মাদ্রাসার এমপিওভুক্তি নিয়ে সুখবর

১০

একবার ফোন চার্জ দিলে কত টাকা খরচ হয় আপনার? জেনে নিন

১১

১২ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স এলো ১২ দিনে

১২

ভারতকে পাক সেনাপ্রধানের পরমাণু যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

১৩

এসএসসি পাসেই পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি, নেবে ২৮৪ জন

১৪

বিচ্ছেদের পর কাজ থেকে বিরতি, এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ফারিয়া

১৫

হস্তান্তরের আগেই নবনির্মিত স্কুল ভবনে ফাটল

১৬

পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়ায় শিক্ষিকাকে মারধর করল ছাত্র

১৭

অভাব-ঋণের ভারে মা-মেয়ের বিষপান

১৮

বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি ধর্মভিত্তিক দল : রিজভী

১৯

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় যে ৬ খাবার, বাদ দিন এখনই

২০
X