উত্তরার আবদুল্লাহপুর পার হলেই শুরু হয় গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এই প্রবেশপথটিই যেন অপরাধ জগতের গেটওয়ে। ছিনতাই, খুন, মাদক ও সশস্ত্র হামলার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে এখানে। মহানগরের অন্তত পাঁচটি এলাকা—টঙ্গী স্টেশন রোড, টঙ্গী উড়ালসড়ক, চান্দনা চৌরাস্তা, কোনাবাড়ী ও জয়দেবপুর এখন পুলিশের চোখে ‘অপরাধপ্রবণ এলাকা’।
স্থানীয়দের অভিযোগ, থানাসংলগ্ন এলাকাতেই ছিনতাইকারীরা নির্ভয়ে অবস্থান নেয়, আর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় রাত নামলেই যেন অপরাধীদের রাজত্ব শুরু হয়। টঙ্গী উড়ালসড়ক এবং স্টেশন রোড এলাকায় যানবাহন থামিয়ে ছিনতাই, এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে বলে দাবি বাসিন্দাদের।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম সাত মাসে ৮টি থানায় মোট ৪৩টি হত্যাকাণ্ড রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে সদর থানায় ১১টি, টঙ্গী পূর্বে আগস্ট ২৪ থেকে আগস্ট ২৫ পর্যন্ত ২২টি, টঙ্গী পশ্চিমে ৭টি, কোনাবাড়ীতে ৭টি, গাছায় ৫টি, পূবাইলে ৪টি, বাসনে ৫টি এবং কাশিমপুরে ৪টি হত্যা মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের তুলনায় চলতি বছরে হত্যাকাণ্ডসহ চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির হার কয়েকগুণ বেড়েছে।
টঙ্গীতে সাম্প্রতিক কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে— ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীর হাতে রনজু খাঁ নিহত, সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের সামনে কলেজছাত্র মাহফুজুর রহমানকে খুন এবং চাঁদাবাজির জেরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় কোনাবাড়ীর প্রবীণ নাসির পালোয়ানের মৃত্যু। প্রতিটি ঘটনাই এলাকাবাসীর আতঙ্ক বাড়িয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, টঙ্গীতে অসংখ্য বস্তি রয়েছে, যেখানে সারাদেশ থেকে অপরাধ করে পালিয়ে আসা অপরাধীরা লুকিয়ে থাকে। এসব বস্তি অনেক সময় অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়। আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি—ভয়ংকর মাদক কারবারি, ছিনতাইকারী বা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউই রেহাই পাবে না। অপরাধী যেই হোক, কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় অপরাধচক্রকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যেন টঙ্গীসহ পুরো মহানগরে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা যায়, এজন্য প্রতিটি অপরাধের ঘটনা গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে এবং প্রয়োজন হলে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা হবে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান কালবেলাকে জানান, বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে, যা অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পূর্বের প্রভাবশালী অপরাধচক্রও পরিস্থিতিকে জটিল করছে।
তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মোটরসাইকেল তল্লাশি, সিভিল পোশাকে নজরদারি এবং রাতভর টহল জোরদার করা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বেকারত্ব ও পুলিশের সীমিত উপস্থিতি পরিস্থিতি অবনতির জন্য দায়ী। প্রশাসনকে শুধু টহল নয়, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান চালাতে হবে।
এলাকাবাসীরা বলছেন, সন্ধ্যার পর টঙ্গী ও আশপাশের এই এলাকাগুলোতে বের হতে ভয় লাগে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাতে চলাচল প্রায় বন্ধ। স্থানীয়দের দাবি, পুলিশ-জনগণের যৌথ উদ্যোগে অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি।
মন্তব্য করুন