কিশোরগঞ্জে চুরির অপবাদ দিয়ে জনসমক্ষে এক যুবককে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে আব্দুস সালাম নামে আওয়ামী লীগের এক নেতার বিরুদ্ধে।
গত বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নে এই ঘটনা ঘটে। এমন একটি ভিডিও এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছড়িয়ে পড়েছে।
অভিযোগ ওঠা আব্দুস সালাম বৌলাই ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক।
জানা যায়, বৌলাই ইউনিয়নের পুরান বৌলাই গ্রামে গত মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে আব্দুল কদ্দুসের ছেলে সজল মিয়ার বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটে। এ সময় সন্দেহজনক একই এলাকার সোহরাব উদ্দিন ও এরশাদ মিয়াকে ভুক্তভোগীর বাড়ির পাশ থেকে আটক করা হয়। পরে ওইদিন রাতে স্থানীয় গ্রাম্য মাতবরদের মধ্যস্থতায় সমাধান করে তাদের সহায়তায় অভিযুক্ত সোহরাব উদ্দিন ও এরশাদ মিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে পরেরদিন বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকালে আবারও গ্রাম্য সালিশ ডেকে তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়। এ সময় তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে চুতরা পাতা লাগানো, বেত্রাঘাত, লাঠি দিয়ে পেঠানো, কিল-ঘুসি দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, দুজনকে এক লাখ টাকা আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। পরিশোধের জন্য ১৫ দিন সময় বেঁধে দেন আব্দুস সালাম।
ছড়িয়ে পড়া ২ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, বৌলাই ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালাম এরশাদ মিয়াকে কঞ্চি দিয়ে বেত্রাঘাত করছেন। কিন্তু এরশাদ মিয়া বারবার এদিকে কখনো আসেননি বলে সালামের কাছে আকুতি করছেন। এরশাদ মিয়া কসম খেয়ে হাত-পা ধরে বারবার বলে যাচ্ছেন, আমি এদিকে আসিনি। আমি আর পরশ ভাই বাগানে বসে ছিলাম। আমি তো এখন এখানে বসে আছি আপনারা পরশ ভাইকে আলাদা গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। সে তো আর বানিয়ে বলতে পারবে না। তারে গিয়ে একটু জিজ্ঞেস করেন। এখানে শুধু আমি আর পরশ ভাই বসে ছিলাম। প্রথম আমি (এরশাদ মিয়া), পরশ ও সোহরাব উদ্দিন আমাদের ঘরের বারান্দায় বসে মোবাইল চালিয়েছি। পরে সোহরাব উদ্দিন সাবেক মেম্বার লালু কাকার সঙ্গে চলে আসে। এ সময় গ্রাম্য সালিশে আহত অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায় সোহরাব উদ্দিনকে।
পরে আব্দুস সালাম গ্রাম্য সালিশে রায় ঘোষণা করে বলেন, আমি তাদের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছি। এরশাদ মিয়া দেবে ৫০ হাজার ও সোহারাব উদ্দিন দেবে ৫০ হাজার টাকা। আগামী ১৮ তারিখের মধ্যে টাকাগুলো সজল মিয়াকে দিয়ে দিতে হবে।
চুরির অপবাদে অভিযুক্ত সোহরাব উদ্দিন বলেন, আমার অনেকদিন ধরে মাছ ধরার নেশা। ওইদিন রাত আনুমানিক ৩টা বাজে সাবেক মেম্বার হাছান রাব্বানী লালুর সঙ্গে মাছ ধরতে যাই। সজলদের বাড়ির পাশে একটা ব্রিজ আছে সেটা পার হয়ে যাওয়ার পর শুনতে পায় পাশের বাড়ির লোকজন চিৎকার কর বলছে চোর আসছে। চিৎকার শুনে মেম্বার ও আমি দুজন ওইখানে যাই এবং চোর খুঁজতে বের হই। একপর্যায়ে আমাকে চোর বলতেছে। আমি মেম্বারকে নিয়ে তাদের বাড়িতে যাই এসময় সজলের ভাই স্বপন আমাকে শার্টের কলারে ধরে মারধর করে। পরে মেম্বার আমাকে বাঁচিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, সেখান থেকে আমি বাড়িতে চলে আসি। বুধবার সকালে আবার আমাকে গ্রাম্য সালিশে যাওয়ার জন্য ডাকলে আমি যাওয়া মাত্র শার্টের কলারে ধরে বাড়িতে নিয়ে টর্চার করে। আমাকে চোর বলে আমার শরীরে আঘাত করা হয়। লাঠি দিয়ে পিঠিয়েছে, চুতরা গাছ দিয়ে পিঠিয়েছি, কিলঘুসি তো আছেই। আর এরশাদ ছিল আলাদা। এরশাদকেও বাইরে থেকে আনা হয়। আমি এই ঘটনার বিচার চাই।
সাবেক মেম্বার হাছান রাব্বানী লালু বলেন, সোহরাবকে শুধু শুধু চোরের অপবাদ দেওয়া হয়েছে। আমি রাতে জাল দিয়ে কিংবা লাইটের আলো দিয়ে মাঝে মধ্যে মাছ ধরি। সে আমার সঙ্গে মাছ ধরতে এসেছিল। এসময় সজলের ভাই স্বপন নিজেও আমার সঙ্গে তাকে (সোহরাব) দেখেছে বাড়ির পাশে ব্রিজের ওপর তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। চোর আসছে শুনে আমি ও সোহরাব দুজন মিলে আমার বাড়ি থেকে সজলদের বাড়িতে যাই। সেখানে যাওয়ার পর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে মারধর করা হয়েছে। পরেরদিন দরবারের কথা বলে এনেও তাকে মারধর করা হয়েছে। কাজটি মোটেও ঠিক করেনি। চুরির অপবাদ দিয়ে জরিমানাও করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আলম বলেন, আমি সোহরাবের সঙ্গে একসঙ্গে বড় হয়েছি। সে যে চোর, এটা কোনোদিন সম্ভব নয়। সে সবার সাথে হাসি খুশি থাকে। রাতে একটু মাছ ধরে এইটাই জানি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সরেজমিন বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পুরান বৌলাই এলাকায় গেলে সজলের লোকজন গাড়ি থামিয়ে সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে নিষেধ করে। বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলবে না জানিয়ে রাস্তা থেকে চলে আসতে বাধ্য করা হয়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালাম বলেন, সজল মিয়ার ঘর থেকে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ও ২টি মোবাইল চুরি হয়েছে। অভিযুক্ত এরশাদ মিয়াকে সালাম তার আত্মীয় দাবি করেন। সেজন্য তাকে শাসন করেছেন। তাতে তার (আব্দুস সালাম) সাজা হলে হবে বলে জানান।
অভিযুক্তদের দরবারে চোর হিসেবে প্রমাণ করতে পারলেন কি? এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি আব্দুস সালাম। বিষয়টি নিয়ে আবারও সজলের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান।
কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, আমার কাছে চোর ধরা হয়েছে বলে কোনো সংবাদ আসেনি। কাউকে পেটানোর অধিকার দেশের আইন সমর্থন করে না। নির্যাতনের অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন