বিগত কয়েক দশকে উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আধুনিক সরঞ্জামে বাজার ছেয়ে যাওয়ায় দিন দিন ভাটা পড়েছে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় দেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য মৃৎশিল্পে। এতে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মৃৎশিল্পীরা পড়েছেন বিপাকে।
পূর্বপুরুষ থেকে বংশপরম্পরায় পাওয়া এই পেশা বদলে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন অনেক মৃৎশিল্পী। তবে এখনো ভাটা পড়া এই শিল্পেই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন ঐতিহ্যবাহী এই পেশা আঁকড়ে ধরে থাকা মৃৎশিল্পীরা।
মৃৎশিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটা সময় মাটির তৈরি নানারকম পণ্য এই উপজেলার মানুষের দৈনন্দিন চাহিদায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। সময়ের পরিক্রমায় শিল্পায়নের এই যুগে বাজারে মেলামাইন, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের প্রসারে মাটির তৈরি জিনিসের কমেছে চাহিদা। ফলে পরিবারের চাহিদা মেটাতে বংশপরম্পরায় পাওয়া এই পেশা বদল করে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন অনেক মৃৎশিল্পী। মৃৎপল্লীর নতুন প্রজন্মের মধ্যেও এই শিল্প নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যার ফলে এই উপজেলায় বাঙালি ঐতিহ্যের এই শিল্প পড়েছে হুমকির মুখে।
তবে এখনো কিছু পরিবার বাপ-দাদার আদি পেশা ধরে রাখতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পকে। প্রধান পেশা হিসেবে এখনো তারা এই শিল্পে দিন-রাত দিয়ে যাচ্ছেন শ্রম। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ভাটা পড়া এই শিল্পকে তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন শুধু কাজের প্রতি ভালোলাগা আর ভালোবাসা ও পূর্বপুরুষের পেশাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ও সরকারের কাছ থেকে সময়োপযোগী সহযোগিতা পেলে তারা এই ভাটা পড়া শিল্পকে আগলে রেখেই আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের ষাইটশালা পালপাড়ায় একসময় ঘরে ঘরে মাটি দিয়ে তৈরি হতো নানারকম ব্যবহারিক পণ্য। মৃৎশিল্পীরা দক্ষ হাতে কাদামাটি দিয়ে সুনিপুণভাবে তৈরি করতেন হাঁড়ি-পাতিল, বাসনকোসন, ঢাকনা, কলসি, শিশুদের খেলনাসামগ্রী ও ঘর সাজানো বিভিন্ন রকম পণ্যসামগ্রী।
তাদের তৈরি এসব পণ্য উপজেলার বিভিন্ন হাটসহ জেলাশহর পেরিয়ে সরবরাহ হতো বিভিন্ন এলাকায়। বর্তমানে বিজ্ঞানের উৎকর্ষে বাজার দখল করা মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের সরঞ্জামের কারণে মৃৎশিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী বাপ-দাদার আদি পেশা ছেড়ে অভাব অনটনের সংসার চালাতে জড়িয়ে পড়ছেন অন্য পেশায়।
একসময় ওই এলাকায় ৪ শতাধিক পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। এদের গল্পটা অতটা সহজ নয়, বরং এই শিল্পীদের জীবনের গল্প একদমই ভিন্ন ও অবহেলা জড়িত। এতো কষ্ট করে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে তারা টিকিয়ে রাখছেন ঠিকই কিন্তু সেই অনুপাতে তারা দেখছেন না লাভের মুখ। এসব মাটির পণ্য তৈরি করতে যে পরিমাণ টাকা ও শ্রম তারা ব্যয় করেন তাতে আহামরি লাভ তো দূরের কথা, কোনোরকমে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। যার ফলে পেশা বদলের ধারাবাহিকতায় এখন মাত্র ৫০টি পরিবার ঐতিহ্যবাহী এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
মৃৎশিল্পী স্বপ্না রাণী পাল, রতন পাল, স্বপন চন্দ্র রুদ্র পাল, চন্দনা রাণী পাল, শান্তি পাল ও অঞ্জনা রাণী পাল জানান, বংশপরম্পরায় পাওয়া এই পেশা দিয়ে সংসার চালানো এখন দায় হয়ে পড়েছে। বর্তমান বাজারে মাটির তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পেশা বদল করছেন অনেকেই। আর্থিক দৈন্যদশা ও যুগোপযোগী যন্ত্রপাতি না থাকায় তারা তৈরি করতে পারছেন না রপ্তানিযোগ্য জিনিসপত্র।
যার ফলে এই পেশায় আলোর মুখ দেখছেন না তারা। এতে দিন দিনই এই শিল্পে পড়ছে বড় রকমের ভাটা। তবে যদি সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকারিভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে বাপ-দাদার আদি পেশাতেই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন তারা। সার্বিক সহযোগিতায় ভাটা পড়া এই ব্যবসাতেই ঘুরে দাঁড়াতে চান তারা। কারণ এটা তাদের পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া বাঙালি জাতির একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা। তাই এই পেশাকেই লালন করে মৃৎশিল্পে আবারও জোয়ার আনতে পরিশ্রম করে যাবেন তারা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. শাহীন কালবেলাকে বলেন, আমার ওয়ার্ডের পালপাড়ায় কিছু লোকজন আছে তারা মাটি দিয়ে হাঁড়ি-পাতিলা তৈরি করে। তবে তারা বর্তমানে খারাপ সময় পার করছেন। আগের মতো মাটির তৈরি জিনিসপত্র বাজারে বিক্রি না হওয়ার কারণে অনেকেই এ পেশা বদলে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। আমি যতটুকু সম্ভব তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। গত ৪/৫ বছর আগে উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে তাদের অনুদান দিয়েছিল। এ বিষয়ে সরকারের কাছে ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে আমার অনুরোধ, তাদের সহযোগিতা করা হলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি টিকে থাকবে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, আমার ইউনিয়নের ষাইটশালা এলাকার কুমার পড়ায় আমি ছোট বেলায় দেখেছি এদের মাটির তৈরির ব্যবসার পরিসরটা বেশ বড়ই ছিল। তবে দিন দিন মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা বাজারে কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসার পরিসরটা অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। এদের মধ্যে যখন যে আমার কাছে এসেছে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সাধ্যমতো আমি সহযোগিতা করেছি। এই শিল্পটি দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে। তবে সরকার যদি তাদের সহযোগিতা করে তবে তারা হয়তো আগের পর্যায়ে ফিরে আসতে পারবে।
মন্তব্য করুন