মাহমুদ মুজিব
প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৩, ০৮:১৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

কুরবান কসাইয়ের গল্প

অলঙ্করণ : আবু হাসান
অলঙ্করণ : আবু হাসান

কসাইপাড়ার কুরবান আলী। সবাই তাকে কুরবান কসাই নামেই চেনে। সারা বছর মফস্বল শহর চকরিয়ার চিরিঙ্গা বাজারে প্রতিদিন গরু জবাই দেন। বাজারে গরু গোশতের আরও দু-তিনটি দোকান থাকলেও, এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে কুরবান আলীর দোকানের গোশতই অধিক প্রিয়। বিকেলের আগেই কুরবান কসাইয়ের দোকানের গোশত শেষ হয়ে যায়। অথচ অন্যান্য দোকানে সন্ধ্যার পরও কিছু কিছু গোশত অবিক্রীত থেকে যায়।

ঈদ, মহররম, শবেকদর, শবেবরাতের মতো বিশেষ দিনগুলোতে অবশ্য একাধিক গরু জবাই করেন। সাধারণ মুসল্লিদের মাঝে গরুর গোশতের চাহিদা বেশি থাকে। বিক্রি-বাট্টাও বেশ জমে! কুরবান আলীর এমন জনপ্রিয়তার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, মৃত বা অসুস্থ গরু জবাইয়ের কোনো বদনাম নেই তার নামে।

দ্বিতীয়ত, ওজনে কম দেওয়া বা বাসি গোশত বিক্রিরও রেকর্ড নেই কুরবান আলীর।

তৃতীয়ত, কুরবান কসাই ব্যক্তিগত জীবনে জামাতে পাঁচ ওয়াক্তের নিয়মিত মুসল্লি।

চতুর্থত, সারা বছর একই দামে গোশত বিক্রি করেন তিনি; বিশেষ দিবসে সাধারণ মানুষদের জিম্মি করেন না। এসব কারণেই এলাকায় কুরবান কসাইয়ের কদর একটু বেশি।

কুরবান আলীর দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে দুটিকে শিক্ষিত ছেলে দেখে পাত্রস্থ করেছেন। একমাত্র ছেলে এ বছর কলেজে উঠেছে। ছেলেমেয়েদের এভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার স্ত্রী করিমা খাতুনের অবদান অধিক। করিমা করাইয়াঘোনা জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের একমাত্র কন্যা। ইমাম সাহেব কুরবানের নামাজ-দোয়া ও সততায় মুগ্ধ হয়ে আপন মেয়েকে কুরবানের সঙ্গে বিয়ে দেন।

যদিও ইমাম সাহেবের আত্মীয়স্বজন অনেকেই এ বিয়েতে অখুশি ছিলেন। ইমাম সাহেব সচেতন ধার্মিক মানুষ। তিনি আত্মীয়স্বজনের কথায় কান না দিয়ে করিমাকে কুরবানের হাতে তুলে দেন এবং আপত্তিকারীদের উদ্দেশে বলেন, কেউ কসাই হলেই মান-ইজ্জত কমে না। কারণ, কসাই তো বৈধ পন্থায় হালাল পশু জবাই করে। আমাদের গোশতের জোগান দেয়। এতে অসম্মানের কিছু নেই। আমাদের বরং সমাজ হন্তারক নেতা কসাইদের ব্যাপারেই কঠোর ও সচেতন হওয়া উচিত। যারা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হরহামেশা সাধারণ মানুষের গলা কাটছে। দেশে অশান্তি ছড়াচ্ছে। এরাই মূলত ঘৃণিত কসাই!

কুরবান আলী নিজে গরু জবেহ করেন না প্রায় দশ বছর। কারণ, তার দোকানে চার কর্মচারী কাজ করে। তারাই মূলত জবাই দেয়। কুরবান আলী সকালে দোকানে যান। মাপজোক ও গোশতের কোয়ালিটির দিকে নজর রাখেন। তবে ব্যতিক্রম কেবল পবিত্র ঈদুল আজহায়। কুরবানির ঈদ এলেই কুরবান আলী নিজ হাতে কোরবানি দেন। উপরন্তু প্রতিবেশীদের পশুও জবাই করে দেন! বিনিময়ে কিছুই নেন না।

কদিন পরই পবিত্র ঈদুল আজহা। এলাকায় সামর্থ্যবান সবারই কোরবানির পশু কেনা শেষ। কুরবান কসাই দোকানের কর্মচারীদের দা-ছুরি রেডি রাখার তাগিদ দেন। এলাকার অনেকেই কুরবান আলীর কাছে এসে পশু জবাইয়ের আবদার জানায়। তিনি খুশিমনে তাদের আশ্বস্ত করেন। এশার সময় মসজিদের মাইকে ঘোষণা আসে, ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, সম্মানিত মুসল্লিকেরাম, আগামীকাল সকাল ৮টায় করাইয়াঘোনা জামে মসজিদে পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে।

ঈদের দিন। নামাজ শেষে কুরবান কসাই প্রথমেই নিজ পশু জবাই দেন। এরপর এলাকার কয়েকজনের পশু জবাই করেন। বাড়ি ফেরার পথে শিকদারপাড়ার নতুন ধনাঢ্য ব্যক্তি ইসমাইল শিকদার কুরবান কসাইকে বলেন, আমাদের পশু জবাইয়ের জন্যে ঠিক করা কসাইকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের গরুটা কি জবাই করে দেওয়া যাবে? কুরবান আলী প্রথমে না করে দিলেও আবার কী ভেবে রাজি হন। গরুটি জবাইয়ের পর কুরবান আলী ঘরে চলে আসেন।

জোহরের নামাজ শেষে কুরবান আলী ঘরে ফিরে জানতে পারেন, শিকদারপাড়া থেকে তিন কেজি গোশত পাঠিয়েছে ইসমাইল শিকদার। কুরবান আলী সঙ্গে সঙ্গে গোশত ফেরত পাঠান। ইসমাইল শিকদারকে কল দিয়ে বলেন, কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে কোরবানির গোশত দেওয়া অবৈধ। নাজায়েজ। বিষয়টা খেয়াল রাখলে ভালো হয়। ইসমাইল শিকদার বলেন, আমরা তো প্রতিবছর কসাইদের পারিশ্রমিক হিসেবে গোশত দিয়ে এসেছি। কই, কেউ তো আপত্তি করেনি কোনোদিন!

তখন কুরবান আলী বলেন, আপনার বিশ্বাস না হলে আমাদের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ইসমাইল শিকদার ঠিক আছে বলে কল কেটে দেয়। সেদিন রাতে শিকদার সাহেব ইমাম সাহেবকে দাওয়াত করেন। ইমাম সাহেব আসেন। খাওয়া-দাওয়ার পর শিকদার কসাইয়ের পারিশ্রমিক হিসেবে গোশত দেওয়ার বিষয়টা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আবেদন করেন। ইমাম সাহেব খুব শান্তভাবে শিকদার সাহেবকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন, আমাদের ইসলাম ধর্মে কোরবানির ঈদে কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে কোরবানির গোশত দেওয়া নাজায়েজ। তাদের বরং আলাদাভাবেই পারিশ্রমিক আদায় করতে হবে। তবে পারিশ্রমিক দেওয়ার পর কেউ চাইলে হাদিয়া বা উপহার হিসেবে কসাইদেরও কোরবানির গোশত দেওয়া যাবে। ইসমাইল শিকদার স্বীয় ভুল বুঝতে পারেন। ইমাম সাহেবের বিদায়ের পর কুরবান কসাইকে কল দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন। কুরবান কসাইও ইসমাইল শিকদারের বোধোদয় ঘটেছে দেখতে পেয়ে ক্ষমা করে দেন।

লেখক : শিক্ষক, জামেয়া দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া চট্টগ্রাম ও বিভাগীয় সম্পাদক, মাসিক আল-হক।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এবার চতুর্থ সারির ক্লাবের কাছে হেরে ম্যানইউর বিদায়

ড. মাসুদের প্রচেষ্টায় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেলো ৩ ইউনিয়নের মানুষ

বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশ স্পিনার

রুমিন ফারহানার দুঃখ প্রকাশ

বৃহস্পতিবার প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা

ভারতে নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়া, বড় ধাক্কায় আইপিএল ও ভারতীয় ক্রিকেট

পদক্ষেপ নিলে মনে হয় দেশেই থাকা হবে না : ডিসি মাসুদ

রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভা

ডিআরইউতে মঞ্চ ৭১–এর কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবি

জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য: উপদেষ্টা

১০

কনভেনশন হলে গেরিলা বৈঠকে গ্রেপ্তার শিমুল ৪ দিনের রিমান্ডে

১১

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

১২

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

১৩

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

১৪

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

১৫

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৬

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

১৭

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

১৮

একাধিক উপকারিতা কাঠবাদামের, যাদের জন্য ক্ষতিকর

১৯

একই দিনে দুইবার পরিবর্তন, রাকসু নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ

২০
X