অনেক গর্ভবতী নারী ব্যথা কমাতে টাইলেনল বা প্যারাসিটামল নামের ওষুধ খেয়ে থাকেন। তবে সম্প্রতি এমন কিছু আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে, গর্ভাবস্থায় প্যারাসিটামল খাওয়ার ফলে ভবিষ্যতে সন্তানের অটিজম হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনও এ নিয়ে সতর্কতা জারি করতে পারে বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম।
২০২৪ সালের এক ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, অটিজমের একটি সম্ভাব্য কারণ তারা হয়তো খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অটিজম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে… আমরা হয়তো এর পেছনের কারণ খুঁজে পেয়েছি।’
তবে এ ধরনের মন্তব্য নিয়ে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট সাবধান। কারণ এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
প্যারাসিটামল (যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাসিটামিনোফেন নামে পরিচিত) হলো একটি বহুল ব্যবহৃত ব্যথানাশক ও জ্বর কমানোর ওষুধ। এটি অনেক দেশে ‘টাইলেনল’ নামে বিক্রি হয় এবং শিশু ও নবজাতকদের জন্য আলাদা সংস্করণও পাওয়া যায়।
বিশ্বের বড় বড় চিকিৎসা সংস্থা যেমন- আমেরিকান কলেজ অব অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনোকোলজি (ACOG), যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) — এই সংস্থাগুলো বলছে, প্যারাসিটামল গর্ভবতী নারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ব্যথানাশক হিসেবে বিবেচিত।
তারা বলেছে, সীমিত পরিমাণে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করলে গর্ভের সন্তানের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না।
টাইলেনলের উৎপাদক সংস্থা ‘কেনভিউ’ও জানিয়েছে, গর্ভাবস্থায় এটি নিরাপদ। তবে তারা এবং চিকিৎসকরা— সবাই পরামর্শ দেন, গর্ভাবস্থায় যে কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তাহলে টাইলেনল কি সত্যিই অটিজমের কারণ হতে পারে? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হলো : না, এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রমাণ নেই।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় যদি অতিরিক্ত বা দীর্ঘদিন প্যারাসিটামল খাওয়া হয়, তাহলে সন্তানের স্নায়বিক সমস্যার সম্ভাবনা সামান্য বাড়তে পারে।
তবে এটি কখনোই প্রমাণিত হয়নি যে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়ার কারণেই অটিজম হয়।
২০২৪ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মনিক বোথা বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে প্যারাসিটামল অটিজমের কারণ।’
অন্যদিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, প্যারাসিটামল ব্যবহারে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো। তবে মায়ের শরীরে জ্বর বা ব্যথা থাকলে সেটাও শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
প্যারাসিটামল একটি নন-ওপিওয়েড ব্যথানাশক। এটি আমাদের মস্তিষ্কে ব্যথা ও জ্বরের সংকেত নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যদিও এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন যে এটি কীভাবে কাজ করে, তবে ধারণা করা হয়:
- এটি মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহকগুলোর (যেমন প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন) কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে।
- প্যারাসিটামল শরীরে গিয়ে AM404 নামের একটি যৌগ তৈরি করে, যা ব্যথা কমাতে ভূমিকা রাখে।
- প্যারাসিটামল খেতে হলে অবশ্যই সঠিক ডোজ মেনে চলা উচিত।
NHS অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য সাধারণ ডোজ
- একবারে ১টি বা ২টি (৫০০ মিলিগ্রাম) ট্যাবলেট
- দিনে সর্বোচ্চ ৪ বার
- সর্বোচ্চ ৮টি ট্যাবলেট (৪,০০০ মিলিগ্রাম) ২৪ ঘণ্টায়
সতর্কতা : এই সীমা ছাড়িয়ে গেলে লিভার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে হঠাৎ লিভার বিকলের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্যারাসিটামল ওভারডোজ।
অনেক সময় অনেকে না বুঝেই একসাথে একাধিক ওষুধ খেয়ে ফেলেন যেগুলোর সবগুলোতেই প্যারাসিটামল থাকে। এতে দৈনিক সীমা ছাড়িয়ে যায়।
শিশুদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা জরুরি, বিশেষ করে যদি বাচ্চা একাধিক জায়গায় যত্ন পাচ্ছে (যেমন : ডে-কেয়ার, দাদির বাড়ি ইত্যাদি)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, হালকা থেকে মাঝারি ব্যথা ও জ্বর কমানোর ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল প্রথম পছন্দের ওষুধ।
গবেষণায় দেখা গেছে, এটি কার্যকর
- তীব্র মাথাব্যথা বা মাইগ্রেন
- অস্ত্রোপচারের পর ব্যথা
- প্রসব-পরবর্তী ব্যথায়
তবে কম কার্যকর বা সীমিত ফল দেয় : হাঁটুর আর্থ্রাইটিস, কোমরের ব্যথা বা ক্যানসার-সংশ্লিষ্ট ব্যথায়
গর্ভাবস্থায় ব্যথা বা জ্বর হলে প্রথমে ঘরোয়া পদ্ধতিতে চেষ্টা করুন, যেমন বিশ্রাম, হালকা স্নান বা গরম পানির ব্যাগ। তবে যদি ওষুধ লাগেই, তাহলে প্যারাসিটামল এখনো চিকিৎসকদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ বিকল্প।
- নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ খাবেন না
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ডোজ বাড়াবেন না
- প্যারাসিটামল আছে এমন একাধিক ওষুধ একসাথে খাবেন না
গবেষণা এখনো চলছে। অটিজম অনেক জটিল একটি অবস্থা যার পেছনে জেনেটিক এবং পরিবেশগত নানা কারণ কাজ করতে পারে। শুধুমাত্র একটি ওষুধকে দায়ী করা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
সতর্ক হোন, সচেতন থাকুন, এবং যেকোনো ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
মন্তব্য করুন