তখন ২০১৮ সাল, অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। ভীষণ গবেষণার শখ আমার। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই। বিভাগীয় শিক্ষকরাও আমার এই বাসনার কথা জানতেন। হঠাৎ করে সুযোগ এসে গেল একটা গবেষণায় যুক্ত হওয়ার। আমার বিভাগের প্রিয় শিক্ষক মনোয়ার কবীর স্যার ডেকে বললেন তার বান্ধবী তাসনিম সিদ্দিকী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করবেন। আমি কাজ করার সুযোগটা নিতে চাই কি না। আমাকে আর পায় কে, এককথায় রাজি হয়ে গেলাম এবং সেদিনই অ্যাপ্লাই করে ফেললাম। উত্তেজনায় সারারাত ঘুম এলো না। এর কিছুদিন পর ইন্টারভিউ এর জন্য মেইল পেলাম, রামরু থেকে গবেষকদল এসে ইন্টারভিউ নিলেন, সিলেক্টেডও হয়ে গেলাম। ট্রেনিং এ আমরা এক অভিনব গবেষণা পদ্ধতির সাথে পরিচিত হলাম- ফটোভয়েস মেথড।
তাসনিম সিদ্দিকীই প্রথম যিনি বাংলাদেশে এই মেথড ব্যবহার করে গবেষণা করেন। ফোটোভয়েস সামাজিক গবেষণার এমনই এক পদ্ধতি যেখানে আমরা একটি কর্ম এলাকার প্রতি ঘরে ঘরে শুমারি করে তার থেকে দৈবচয়নের মাধ্যমে কিছু ঘর বেছে নিয়েছি এবং পরবর্তীতে তাদের অভিবাসনের গল্প শুনে তাদের হাতে ক্যামেরা তুলে দিয়ে এসেছি। বলেছি গ্রাম থেকে এই শহরে এসে নারী, পুরুষ বা শিশু হিসেবে জীবনধারণ করতে গিয়ে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করছেন তাকে ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করুন।
তারপরে সেই ছবিগুলোকে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করুন, সেই ব্যাখ্যাই ড. তাসনিম সিদ্দিকী জার্নাল আর্টিকেলের মাধ্যমে নিয়ে যাবেন সারা বিশ্বের কাছে। ট্রেনিং শেষ করে ফিল্ডওয়ার্কে নেমে পড়লাম। সেদিন বুঝতেই পারিনি যে আমার জীবনে এক নতুন মোড় এসে গেছে। শুরু হলো আমার এক ঝাঁক তরুণ গবেষকদের সঙ্গে উদয়াস্ত পরিশ্রম। রোদ-বৃষ্টি-বাদলা এসব যেন কিছুই না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের জীবন সংগ্রামটা কে বোঝা ই যেন আমাদের একমাত্র নেশা।
তথ্য সংগ্রহ, তথ্য লিপিবদ্ধ করা সবই চলছিল, কিন্তু তাসনিম সিদ্দিকীর দেখা তো মিলছিল না। এর মধ্যে তার বেশ কিছু বই পড়া হয়ে গেছে। আমাকে সবচেয়ে বেশি আপ্লুত করেছিল তার ‘আনটোল্ড স্টোরিজ অফ মাইগ্রেন্টস : ড্রিমস অ্যান্ড রিয়ালিটিজ’ বইটি। বুঝলাম অনেক বড় মাপের গবেষক তিনি। অবশেষে ২০১৮ এর ডিসেম্বরে তার দেখা মিলল, গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতমূলক ওয়ার্কশপে। দেখলাম বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রামের মেয়র, সিটি প্ল্যানার, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে বস্তি এলাকায় বসবাসরত অভিবাসী নারী-পুরুষদের নিয়ে কি চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করলেন এত বড় একটি ওয়ার্কশপ। কত সহজে মিশে গেলেন আমাদের সঙ্গে। মনেই হলো না যে আজই আমাদের প্রথম দেখছেন।
এর মাসছয়েক পরে আবার ডাক এলো রামরু থেকে, ম্যাডামের না কি আমার কাজ খুব পছন্দ হয়েছে, আরেকটি গবেষণায় আমাকে যুক্ত করতে চান। আমি তো মহা খুশি, দ্বিতীয়বার ভাবলাম না, যুক্ত হয়ে গেলাম এই গবেষণাটির সঙ্গেও। এ আরেক সম্পূর্ণ ভিন্ন গবেষণাক্ষেত্র। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন তারা বিভিন্ন ফোরামে বলতে শুরু করেন অভিবাসী কর্মীরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই গবেষণার মাধ্যমে প্রফেসর তাসনিম সিদ্দিকী আমাদের সব তরুণ গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করলেন বাস্তব জ্ঞান। আমরা তথ্য দিয়ে প্রমাণ করলাম যে অভিবাসীদের নাশকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঘটনা একেবারেই নেই বরং তাদের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করলে আমাদের শ্রম বাজারের ওপর পড়বে এর বিরূপ প্রভাব। তখন দেখেছি কি পরিমাণ দরদ রয়েছে তাসনিম ম্যাডামের অভিবাসীদের বিষয়ে।
এরই ভিতরে ফুল টাইম কর্মী হিসেবে জয়েন করলাম রামরুতে। ২০২০-২০২২ পর্যন্ত তাসনিম ম্যাডামের সঙ্গে যে মাঠ গবেষণা আমরা করেছি তারই ফসল আজকের ‘ইমপ্যাক্ট অব মাইগ্রেশন অন ট্রান্সফরমেশন টু সাস্টেইনিবিলিটি পোভার্টি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ বইটি। হাতে কলমে গবেষণা শেখার এমন সুযোগ যা আমি পেয়েছি তাসনিম সিদ্দিকীর সঙ্গে কাজ করে তা খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই পেয়ে থাকে।
গত এক বছর ধরে তাসনিম সিদ্দিকীর আন্তর্জাতিক গবেষণা যোগাযোগ আমি রক্ষা করছি। মাঝে মাঝেই আমি খেই হারিয়ে ফেলি। প্রতিদিন অন্তত দুয়েকজন পিএইচডি গবেষক বিদেশ থেকে ইন্টারভিউ করেন তাকে। একযোগে চলছে ৫টি বহুদেশীয় কনসোর্শিয়াম করে গবেষণা। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের গবেষকেরা একত্রে কাজ করেন বলে এই মিটিংগুলো প্রায়ই থাকে রাতে।
আবার সকাল সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত লেখালেখি করেন নিজ বাসায়। আমার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে সকাল নটার থেকে। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজের অন্ত ছিল না তার, সেগুলোর সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে বিভিন্নরকম ডেটা এনালিসিসের কাজের নির্দেশনা দিতেন। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এটা বুঝেছি যে কোনো কাজকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।
গবেষক তাসনিম সিদ্দিকীর পাশাপাশি আমি সুযোগ পেয়েছি আরেকটি তাসনিম সিদ্দিকীকে দেখার। তিনি কিন্তু ঘোর সংসারী। কাজের ভেতর থেকে উঠে গিয়ে তিনি যেকোনো রান্নার মশলাগুলো দিয়ে আসেন। রান্না শেষে আবার গিয়ে তার সবকিছু ঠিকঠাক কি না নিজেই দেখেন। ঘোর কাজের ভেতরে বৃষ্টি নামলে তাকে কেউ ধরে রাখতে পারে না। দৌড়ে বাড়ির সব কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজেন। আমাকে ডাকেন কিন্তু আমি সাড়া দেই না বলে আমাকে তিরস্কার করেন। গাছ তার প্রাণ। তার শোবার ঘরের সামনে রয়েছে ঘাস এবং গাছগাছালিতে ভরা একটা ছোট্ট ওয়েসিস। কাজ করতে করতে পড়ার ঘর থেকেও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন গাছের সবুজ পাতাগুলোর দিকে। সোনালি ফুল যখন ফোটে তখন ম্যাডাম একেবারেই আত্মহারা। তার ছাদজুড়ে যেমন রয়েছে সবজি তেমনি রয়েছে গোলাপসহ নানা ফুল।
তরুণ গবেষকদের নিজস্ব গবেষণা দক্ষতা স্ফুরণের এক অনন্য সুযোগ প্রফেসর সিদ্দিকী সৃষ্টি করেছেন। এসব গবেষণায় অংশগ্রহণের রেফারেন্স ব্যবহার করে গত প্রায় ৩০ বছরে অগণিত ছাত্রছাত্রী মাস্টার্স এবং পিএইচডি করতে বিদেশে গিয়েছে। গত এক বছর ধরে আমি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তাসনিম ম্যাডাম বলেন অচিরেই আমার এ সুযোগ তৈরি হবে। তার কথা যেন সত্য হয়।
মো. রিদওয়ানুল ইসলাম চৌধুরী, গবেষক।
মন্তব্য করুন