সানিয়া মাহিউ
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৫০ পিএম
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:০১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ফ্রান্সের নির্বাচনে কট্টরপন্থিদের উত্থান, চিন্তিত সংখ্যালঘু ও দ্বৈত নাগরিকরা

ফ্রান্সে প্রথম ধাপের নির্বাচনে জয় পেয়েছে কট্টর ডানপন্থিরা। ছবি : সংগৃহীত
ফ্রান্সে প্রথম ধাপের নির্বাচনে জয় পেয়েছে কট্টর ডানপন্থিরা। ছবি : সংগৃহীত

২২ বছর বয়সী ফরাসি মুসলিম নারী, ফাতিমাতার কাছে ইদানীং মনে হচ্ছে, যেন তার অনেক স্বদেশী তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। রবিবার, কট্টর ডানপন্থিরা সংসদীয় নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। যদিও মেরিন লে পেনের ‘ন্যাশনাল র‍্যালি’ মুভমেন্ট ৭ জুলাইয়ের রানঅফ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে কি না তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে, নির্বাচনের এই ফলাফল নিয়ে ফাতিমাতার মতো ফ্রান্সের ষাট লাখ মুসলমানই এখন চরম ভয় এবং আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, জনসম্মুখে বোরখা ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার জন্য প্রচারণা চালানো একটি দলটিকে ১০.৬ মিলিয়ন মানুষ ভোট দিয়েছে, এটি জেনে মনে হচ্ছে, ফ্রান্স আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। ফাতিমাতা আরও বলেন, তিনি এমন ধরনের ফরাসি নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করেন, লে পেনের পার্টির হয়ে যারা দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে শয়তানি করে আসছে। তিনি হিজাব পরেন এবং তিনি বিদেশি পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা মৌরিতানিয়া এবং সেনেগাল থেকে এসেছেন। তিনিও দ্বৈত নাগরিক। ফাতিমাতা প্যারিসের চারপাশের দরিদ্র উপশহরগুলোর একটিতে বেড়ে ওঠেন। যেখানে আরও অনেক অভিবাসী এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।

লে পেন পাবলিক প্লেসে হিজাব নিষিদ্ধের ডাক দিয়েছেন। অন্যদিকে, আগামীতে ফ্রান্সের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী এবং লে পেনের অনুসারী জর্ডান বার্ডেলা, বোরকাকে বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি প্যারিসের উত্তরে জনবহুল উপশহরগুলোতে বসবাসরত জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। অথচ, তিনি বেড়ে উঠেছেন - সেইন-সেন্ট-ডেনিস -এ। ক্ষমতায় গেলে দ্বৈত নাগরিকদের সবচেয়ে কৌশলগত রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নিষিদ্ধের অঙ্গীকার করেছেন তিনি। ২৮ বছর বয়সী বারদেলা গত জুনে বলেন, আমি নিজ দেশে প্রবাসী হওয়ার বিষয়টি অনুভব করেছি। একইসঙ্গে, আমার আশপাশে যে ইসলামি পরিবেশ গড়ে তোলা হচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতাও রয়েছে।

ফাতিমাতা একজন ছাত্রী যিনি সেইন-সেন্ট-ডেনিসের একটি কমিউনিটি থেকে উঠে এসেছেন। এমনও হতে পারে যে, ছোটবেলায় তিনি হয়ত বারদেলার পাশ দিয়েই বাজারে হেঁটে গেছেন কিংবা ক্যাফেতে তার পাশেই বসে সময় কাটিয়েছেন। ফাতিমাতা বলেন, আমি ১৩ বছর বয়সে ফরাসি নাগরিকত্ব পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি ভাবতেই পারি না, আমার ব্যানলিউরের (দরিদ্র উপশহর) একটি ১৩ বছর বয়সী মেয়ে আমার মতো সবকিছু অর্জন করতে সক্ষম হবে না। কারণ, ফ্রান্সে প্রধান দল এখন ন্যাশনাল পার্টি। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপস করছি।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাম্প্রতিক নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থীদের কাছে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন তা সফল হয়নি। রবিবারের ভোটে ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টি প্রায় এক তৃতীয়াংশ তথা ৩৩.১৫ শতাংশ এবং বামপন্থি জোট- নিউ পপুলার ফ্রন্ট ২৮.১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ম্যাখোঁকে এবারও বামেরা লালকার্ড দেখিয়েছে। ফলে, তার মধ্যপন্থি জোট মাত্র ২০.৭৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। তবে, এবার চরম ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে সমাবেশে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে এসেছে।

২৭ বছর বয়সী ইলিয়াস, যিনি বিপণন বিভাগে কর্মরত। তিনি বলছেন, যদি ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় বসে, তাহলে অনেক মুসলিম ফ্রান্স ত্যাগ করবেন। বিষয়টি এরই মধ্যে অনেক পেশাদারকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে La France, tu l’aimes mais tu la quittes (অর্থাৎ, ফ্রান্স ভালোবাসলেও ব্যাপারটি এড়িয়ে যাচ্ছে) শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণায় এক হাজারেরও বেশি মানুষের ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। যেখানে প্রত্যেকের ১৪০ মিনিটের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তারা বলেছেন, ইসলামোফোবিয়ার ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ফরাসি মুসলমানদের অনেকেই চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। দেশত্যাগের ফলে ফ্রান্স মেধা শূন্য হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তারা। এই বৈষম্যের মধ্যে কট্টর ডানপন্থিদের উত্থানে সংগত কারণেই ইলিয়াস তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তিনি এখন বিভক্তির গন্ধ পাচ্ছেন। আলজেরিয়ান বংশোদ্ভুত ইলিয়াস বলেন, আমরা যদি সবাই চলে যাই, কে প্রতিরোধ করবে? আমি মনে করি, অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের থাকাটা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও যে বিষয়টি আমাকে খুবই ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো- সম্ভাব্য পুলিশি নির্যাতন বেড়ে যাওয়া। সামনের দিনগুলোতে হয়ত জাতিগতভাবে চিহ্নিত করার কারণে সহিংসতার ঘটনাও বাড়বে। কারণ পুলিশ কর্মকর্তারা তখন অন্যায় করলেও ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টি তাদের সুরক্ষা এবং সমর্থন দেবে। আমি আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বেশি ভয় পাচ্ছি। তার বয়স এখন ১৫ বছর এবং মাত্র ১৩ বছর বয়সে পুলিশি তল্লাশির শিকার হয়েছিল সে।

পূর্বে ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টি ন্যাশনাল ফ্রন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭২ সালে মেরিন লে পেনের বাবা জিন মেরি লে পেন দলটি প্রতিষ্ঠাতা করেন। লে পেন সিনিয়রের রোপণ করে যাওয়া উগ্র ডানপন্থা নীতিকে কিছুটা শিথিলের পদক্ষেপ নিয়েছিলো সংগঠনটি৷ লে পেন সিনিয়র বর্ণবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বর্ণবাদের দায়ে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। ফরাসি আইন বিশেষজ্ঞ রিম-সারাহ আলাউয়েন বলছেন, ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টির কিছু লক্ষ্য পূরণ করা তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব হবে।

আল জাজিরাকে আলাউয়েন বলেন, জনসম্মুখে বোরখা নিষেধাজ্ঞার বিলটি ল্যাসিটি (ধর্মনিরপেক্ষতা) নীতিকে লঙ্ঘন করবে। অন্যদিকে, দ্বৈত-নাগরিকত্বের বিলটি নাগরিকদের মধ্যে সমতার মৌলিক নীতিকে লঙ্ঘন করবে। তিনি আরও বলেন, তবে, ন্যাশনাল র‍্যালি অন্য দলগুলোর মতো একটি রাজনৈতিক দল নয়, যার অর্থ হলো- ক্ষমতায় এলে তারা ব্যতিক্রমী কিছু করতে পারে। তত্ত্বগতভাবে, এই বিলগুলো সংবিধানের পরিপন্থি। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেখতে হবে যে, দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মোকাবিলায় পাল্টা ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে কি না। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ডানপন্থিদের সাফল্যের পিছনে একটি স্বাভাবিককরণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া নিহিত রয়েছে।

ম্যাখোঁর সরকারের অধীনে, বিতর্কিত বিল- যেমন আবায়া নিষেধাজ্ঞা, তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদ আইন এবং অভিবাসন সংক্রান্ত সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলি প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে নাড়া দিয়েছে। প্যারিসের সায়েন্সেস পো ইনস্টিটিউটের ডক্টরাল বিভাগের শিক্ষার্থী বেঞ্জামিন টেন্টুরিয়ার, যিনি মিডিয়াতে কট্টর ডানপন্থিদের বক্তব্যগুলো নিয়ে গবেষণা করেন। তার মতে, ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টির উত্থানকে উগ্র বামপন্থি দানব-এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে জিন-লুক মেলেনচনের ‘ফ্রান্স আনবৌড’ পার্টির পাশাপাশি বর্ণবাদে রূপান্তরিত হওয়া তত্ত্বের সঙ্গেও তুলনা করা চলে। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ১৫ বছর পর, ন্যাশনাল র‍্যালি ঔপনিবেশিক এবং অপরিহার্য বর্ণবাদকে আরও সূক্ষ্মরূপে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বর্ণবাদের সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করতে সফল হয়েছে।

টেন্টুরিয়ার আরও বলেন, ম্যাখোঁর রেনেসাঁ পার্টি পূর্বে যেভাবে দানবীয় কৌশল ব্যবহার করে চরম ডানপন্থিদের কলঙ্কিত করেছিল, তার বিরোধী বামপন্থিদেরও ক্ষেত্রেও একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রচারণা চালানোর সময়, মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদরা নি আরএন, নি এলএফআই (ন্যাশনাল পার্টি কিংবা ফ্রান্স আনবৌড, কোনোটিই নয়) স্লোগান ব্যবহার করেছেন। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, টেইন্টুরিয়ার ইলিয়াসের উদ্বেগকে সমর্থন করেন। ইলিয়াসের মতো তারও আশঙ্কা, অতি ডানপন্থিরা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে পুলিশের নেতৃত্বে বৈষম্য বাড়তে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি ক্ষমতাসীন শক্তি এই ধারণাটি প্রকাশ করে, তাদের মূলনীতি অনুসারে মানুষের প্রতি বৈষম্যের ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য, তাহলে সেটি পুলিশি হয়রানি- নির্যাতনকে বৈধতা দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে তাদের সহিংসতা বাড়তে পারে এটি বৃদ্ধি করতে পারে।

এদিকে, ম্যাখোঁকে একজন অতি-ডান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্রীভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতে হতে পারে। তিনি ভোটারদের মধ্যপন্থিদের পাশে থাকার অনুরোধ জানিয়ে এই বলে অশুভ সতর্কবাণী দিয়েছেন, কট্টরপন্থি ডান কিংবা বামেরা বিজয়ী হলে ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে।

মূল: সানিয়া মাহিউ; ভাষান্তর: মোহসিন কবির (আল জাজিরা অবলম্বনে অনূদিত)

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

‘সংস্কার কমিশনকে বলেছি, ৫ আগস্টের আগে জুলাই সনদ করতে হবে’

কোনো দলের সম্পদ নয়, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের : সারজিস

ফিফার নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আরও এক ক্লাব

বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটি গঠন

ওসি পদায়নে ২২ দফা নীতিমালা

সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক সম্পত্তি মেরামতে সহযোগিতা দেবে ভার‍ত

যশোরে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সেনাবাহিনীর সহায়তা

নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা ইমরান খানের সাবেক স্ত্রীর

১০

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের প্রতিবাদে উত্তরায় বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল 

১১

কিছু ষড়যন্ত্রকারী দেশের স্থিতিশীলতা ব্যাহত করতে চায় : এনডিপি

১২

চীন সফর শেষে দেশে ফিরেছেন জামায়াতের আমির

১৩

বাঙলা কলেজ ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবির ও সেক্রেটারি সাকিব

১৪

উপুড় হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস, ডেকে আনছেন যেসব ক্ষতি

১৫

পাল্টা শুল্ক নিয়ে তৃতীয় ধাপের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার

১৬

পুলিশ সদর দপ্তরের পর্যালোচনা / ছয় মাসে ২৭ হত্যার কোনোটিই সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নয়

১৭

‘আঙুল তোলার আগে আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখুন’

১৮

কিডনির সমস্যা আছে কি না জানবেন যেভাবে

১৯

৩ দলকে স্বেচ্ছাসেবক দলের হুঁশিয়ারি

২০
X