সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নিষ্ঠুরতম সংঘাত এবং মানবিক ট্র্যাজেডিগুলোর একটি অন্যতম দৃশ্য দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে। বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতে প্রাণহানি ঘটেছে ৫ লক্ষাধিক মানুষের। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মারা গেছে যুদ্ধের কারণে ঘটা খাদ্যাভাব ও রোগের কারণে। তবে সম্প্রতি এই যুদ্ধ বন্ধে কিছু বাস্তব আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
যদিও নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইয়েমেনিদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কাছে এ কারণে ঋণী যে, তারা বর্তমান শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু করা সম্ভব তার সবই করার চেষ্টা করেছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতির সময় গত অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও তারা এখনও সেটা টিকিয়ে রেখেছে। সংঘাত বন্ধে যা ছিল অন্যতম একটি পদক্ষেপ।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শুরু হওয়া সেই যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি সহিংসতা হ্রাস এবং ইয়েমেনজুড়ে মানবিক কার্যক্রম উন্নত করতে অনেক সহযোগিতা করে। তিন কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল৷
যদিও আবারও পূর্ণ মাত্রায় সহিংসতা শুরুর একটি সত্যিকার সম্ভাবনা রয়েই গেছে। কিন্তু সব পক্ষেরই এই যুদ্ধবিরতিকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা ইয়েমেনে একটি স্থায়ী ও পরিপূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
যদিও সব পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসে একটি পূর্ণাঙ্গ সমঝোতায় পৌঁছানো সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সেখানে ২ কোটির বেশি মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তার মরিয়া প্রয়োজন এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে তা অব্যাহত রাখতে হবে। মৌলিক পরিষেবা প্রদানের জন্য একটি উপায় হতে পারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা।
সৌদি আরব এবং আনসারুল্লাহ (যারা হুতি নামেও পরিচিত), তারা এখন সামনাসামনি বসছে এবং সংকট নিরসনে আলোচনা করছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে সৌদি-ওমানি উচ্চপর্যায়ের দুটি প্রতিনিধি দল সানা সফর করে। এই সফর সৌদি এবং হুথিদের মধ্যে একটি আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে একই সঙ্গে এই অঞ্চলের অন্যান্য শক্তিগুলোকেও এই আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে।
রিয়াদকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আলোচনাগুলোতে ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার, রাষ্ট্রপতির নেতৃত্ব কাউন্সিল (পিএলসি) এবং আনসারুল্লাহ হুতিসহ সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকে।
শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি রোডম্যাপের আলোকে ইয়েমেনের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সংলাপ অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূতের মাধ্যমে এখানে সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শান্তি প্রক্রিয়ায় নারী, যুব প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজসহ সব প্রভাবকদের অবশ্যই যোগদান করতে হবে এবং সবার পরামর্শ নিতে হবে যাতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান সামনে আসে। সবার প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আরও বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছরের বিরোধ শেষে গত মার্চে ইরান ও সৌদি আরব তাদের কূটনৈতিক দূরত্ব ঘোচানোর ব্যাপারে সম্মত হয়। দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক দূতাবাসগুলো নতুন করে চালুর ব্যাপারেও সমঝোতা হয়। চীনের বেইজিংয়ে দুই দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সহায়তায় চুক্তিটি হয়েছিল। এমনকি সৌদি বাদশাহ সালমান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে সৌদি সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন।
এই ধরনের সমঝোতা শুধু ইয়েমেনের জন্য নয়, বরং লেবানন এবং ইরাকসহ আরও অনেক দেশের জন্য সমুদ্র নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতায় ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা আরও জোরদার করে পরের দুটি সমঝোতার ঘটনা। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দুপক্ষের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইয়েমেনি সরকার ৭০৬ জন হুতি বিদ্রোহীকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং হুতি বিদ্রোহীরা বিনিময়ে ১৮১ জন বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কথা জানায়৷
দ্বিতীয়ত, ইয়েমেন সরকার এবং হুতিদের মধ্যে একটি চুক্তির পর লোহিত সাগরে বিকল হয়ে থাকা তেলভর্তি জাহাজ FSO Safer কে অবশেষে নিরাপদ করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। যা এক্সন ভালদেজের চেয়ে চারগুণ বেশি পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে।
এ ছাড়া ছয় বছর পর ২০২২ সালের মে মাসে প্রথম কোনো বাণিজ্যিক বিমান ইয়েমেনের রাজধানী ছেড়ে যায়। এরপর থেকে প্রতিদিন সানা থেকে ফ্লাইটের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬ সালের পর এ বছরের জুন মাসেই প্রথমবারের মতো হজযাত্রীরা সানা বিমানবন্দর থেকে জেদ্দার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। এসব বিষয়গুলো ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরো বেশি সম্ভাবনার আলো দেখায়।
সংঘাত ছেড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইয়েমেনকে আরো অনেকদূর যেতে হবে। সকল পক্ষকে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির দিকে এগোতে হবে যাতে সংকট নিরসনে একটি কার্যকর উপায় বের করে আনা যায়। তারপর সকল পক্ষকে সেই সমঝোতায় আন্তরিক থাকতে রাজি করাতে হবে। ক্ষমতা কাঁঠামোর সমন্বয় করে সকলকে একক টেবিলে বসার একটি উপায় খুজে বের করতে হবে। ইয়েমেনিদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিষয়ে তাদের নিজেদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইয়েমেন সংকটের সমাধান শুধুমাত্র ইয়েমেন বা তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং এটি সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এবং উপর্যুপরি বিশ্ববাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মূল - অ্যান্ড্রু গিলমোর এবং ক্যালাম হামফ্রেস, ভাষান্তর – মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন