অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০১:৪৪ পিএম
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে নির্জীব সময় কাটিয়েছিলাম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি : সৌজন্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি : সৌজন্য

বঙ্গবন্ধুকে আমি ভালোবাসি। তবে এ কথা বলব না যে, তাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। এটা হবে মিথ্যাচার, মানুষ তার নিজকেই বেশি ভালোবাসে। আর যদি আমি বঙ্গবন্ধুকে আমার প্রাণের চেয়ে ভালবাসতাম, তাহলে তার নির্মম হত্যার পর আমি সক্রিয় হইনি কেন কিংবা এ যাবৎ এই অন্যায়কে কেন মুখ বুজে সইলাম? তবে এটুকু বলা যায়, তাকে আমি খুব ভালোবাসি। তিনি আমার দৃষ্টিতে বিশ্বের অনন্যসাধারণ নেতাদের একজন।

তিনি দেশের ও বিশ্বের শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য তাড়িত ও নিপীড়িত মানুষের নেতা। তিনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবি যে কবিতার চরনদ্বয় হচ্ছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও অতুলনীয় গেরিলা যুদ্ধের নেতা। ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ -এর মধ্যে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণগাথা আছে। তার নেতৃত্বে ও আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমার মতো ভীরু, হীনবল ও পেছনে তাকানো মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষটি অস্ত্র ধরতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তবে এ কথা আংশিক হলেও সত্যি যে তার নির্মম মৃত্যুর পর সীমিত শক্তি নিয়ে হলেও রাস্তায় নেমেছিলাম।

আবারও মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার কথায় ফিরে আসি। তার চিন্তা, চেতনা, ধ্যানজ্ঞান ও কর্মে তিনি ছিলেন গরিবের মহান বন্ধু। তিনি গরিবের স্বার্থেই কৃষিতে সমবায়, শিল্পে রাষ্ট্রীয়করণ, প্রশাসনে জেলা গভর্নর প্রথা চালু করেছিলেন। আইন শৃঙ্খলার স্বার্থে ও মুক্তিযোদ্ধাদের পনর্বাসনের জন্য তিনি রক্ষীবাহিনী করেছিলেন।

এ রক্ষীবাহিনী নিয়ে কত কথা হয়েছে। তাকে গণতন্ত্রের হত্যাকারী হিসেবে অপবাদ দেয়া হলেও তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে যারা মোটেই গণতান্ত্রিক অধিকারের যোগ্য নন, তারাও অপরিমিত গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেছেন। সে আমলের পত্রপত্রিকা হাতড়ে দেখলে তা বোঝা যাবে। তবুও তার অপবাদের সীমা-পরিসীমা ছিল না, অপবাদ হচ্ছে তিনি রক্ষীবাহিনী ভারতীয়দের দিয়ে গঠন করেছিলেন; তিনি সেনাবাহিনীকে শেষ করতে রক্ষীবাহিনী করেছিলেন। তার শাহাদতবরণের পর রক্ষীবাহিনীতে একজন ভারতীয়কেও কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত নয়, সেনাবাহিনীতে আত্মীয়করণ করা হয়েছে।

তার মৃত্যুর পর আমরা যে বহুদলীয় গণতন্ত্র পেয়েছি তাতে Democracy শব্দের অর্থ Demo when gets crazy is democracy হয়েছে। তার মৃত্যুর পর Government of the people, by the people and for the people হয়েছে Government off the people, buy the people and far the people। তার মৃত্যুর পর বহু বাহিনী গঠিত হয়েছে তন্মধ্যে RAT, RAB, SWAT রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সেনাসদস্যরাও রয়েছেন। এখন কেউ বলছেন না যে RAB গঠন করা হয়েছে সেনাবাহিনীকে শেষ করে দিতে। তারপরও কতিপয় সেনা সদস্যের মগজ থেকে এ কথা মুছে যাচ্ছে না যে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী বিলুপ্ত নয় বরং সেনাবাহিনীকে আধুনিক, গতিশীল ও যুগোত্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ত বটেই তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও কারও কারও কাছে অপাঙ্ক্তেয়। তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে এরশাদ, খালেদা জিয়াসহ অনেকেই ক্ষমতায় থাকলে কিংবা ক্ষমতায় না থাকলেও সেনাসদনে থাকতে পারেন; তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে পারেন; শেখ হাসিনার ক্ষমতা চলে গেলে তিনি কিংবা তার সমর্থকরা আর ক্যান্টনমেন্টে যেতেই পারেন না। বর্তমানে অবস্থারই অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।

আবার সাধারণ মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার কথায় ফিরে আসি। ১৯৭৫ সালেও বঙ্গবন্ধু গৃহীত সব কটি পদক্ষেপ ছিল দেশের ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষের জন্য। বঙ্গবন্ধু তার কাজ দিয়ে বিদেশে সাম্রাজ্যবাদকে চটিয়েছিলেন। তার উক্তি ‘আমার ভাগ্য যদি চিলির আলেন্দের মত হয় তবুও আমি সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করব না’ থেকে আসলে কী বোঝা যায়? স্বদেশে তিনি খেপিয়েছেন বিত্তবান, ক্ষমতাবান,চক্রান্তকারী ও সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুচরদের। তাই তার পরিণতি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আঘাতটা চূড়ান্ত করার আগে অসিলার প্রয়োজন ছিল। সে জন্য দুর্ভিক্ষ কিংবা বাসন্তির প্রয়োজন ছিল।

গণতন্ত্র হত্যার জিকির তোলা হয়েছিল; রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন নয় ক্ষেত্রভেদে দৈহিক হননের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এসবের পর ১৫ আগস্ট চরম আঘাত হলো। দৈবক্রমে সেদিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন বলে বেঁচে গেলেন। পরিবারের আর সবাই এমনকি অবুঝ শিশু রাসেলকেও প্রাণ দিতে হোল। কারণ চক্রান্তকারীরা জানত যে এ পরিবারের একজনও বেঁচে থাকলে আবারও শোষন মুক্তির সংগ্রাম উজ্জীবিত হবে, আবারও দরিদ্র, অসহায় মানুষদের প্রাধান্য নয়, অন্তত পেটের ভাত নিশ্চিত হবে।

তিনি নিহত হলেন আর তার ফলভোগীরা নীরবে কেউ কেউ চোখের জল ফেললেন কিন্তু প্রতিরোধে তেমন কেউ নেমে আসেননি। ১৫ আগস্ট সকালের পরিস্থিতি আমি দেখেছি। সেদিন যদি ঢাকায় ও প্রতিটি জেলায় ক্ষুদ্র কটি মিছিলও হতো, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেতাম না ঠিকই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার এমন দুরবস্থা হতো না।

আমার শেষ কথা হলো যে, যে মানুষটি গরিব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে নিজের সারাটি জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিলেন সেই মানুষ ও তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে কেউ এগিয়ে এলো না। উপকারভোগী মানুষও তাকে বাঁচিয়ে রাখল না কিংবা তার আদর্শকে সমুন্নত রাখল না।

আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা না এলে দেশের কী হতো, তা আল্লাহ তায়ালাই জানেন। যাক, বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে শেখ হাসিনা এই নিয়ে চতুর্থবার ক্ষমতায় এলেন। দালালির অপবাদ মাথায় নিয়েও বলছি তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতো সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে নিবেদিত।

আমি ফিরিস্তি দেব না, তবুও জ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষকে বলব আপনারা সত্যের সাধক হলে আমার উক্তিটি সমর্থন করবেন যে শেখ হাসিনা বহু ব্যাপারে তার পিতার কার্বন কপি। তার সঙ্গে তার পিতার পার্থক্য হলো তিনি বিশ্ব পুঁজির ব্যাপারে একটু নমনীয়। এটাও তার অনন্য কৌশল। ইতিহাস তাকে শিখিয়েছে যে, গরিব মানুষের জন্য ও ক্ষমতাহীন মানুষের জন্য কিছু করতে হলে মুৎসুদ্দী ও বুর্জোয়াদের কিছু দিয়ে হাতে রাখতে হয়। কেননা, তারা চাইলে যে কোনো মানুষের বিপর্যয় নিয়ে আনতে পারে।

এ যাবৎ শেখ হাসিনা সম্পাদিত ও গৃহীত পদক্ষেপগুলো বিশ্লেষণ করলে আমার কট্টর সমালোচকও আমার সঙ্গে একমত হবেন যে শেখ হাসিনা কৌশলী তবে বিশ্ব পুঁজিবাদের দেশীয় মোড়লদের ব্যাপারে আরও কৌশলী হতে হবে। আমি ভয় পাচ্ছি; আমি ভয় পাচ্ছি কারণ যাদের জন্য তার সংগ্রাম, তারাও কিন্তু দুর্বল ও দৃঢ় ভাবে দাঁড়াতে অসমর্থ। আমি ভয় পাচ্ছি কেননা, আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে নির্জীব সময় কাটিয়েছিলাম। অপরিহার্য কাউকে হারিয়ে আর রিক্ত-দেশ দেখতে চাই না।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় শোক দিবস ২০২৩
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনিয়ে পালাচ্ছিল পুলিশ সদস্য

রাইসিকে উদ্ধারকাজে বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে রাশিয়া

রাইসিকে উদ্ধারের সর্বশেষ অবস্থা জানাল ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

সংস্কারের দুদিন পরই উঠে যাচ্ছে কোটি টাকার কার্পেটিং!

বজ্রপাতে কলেজছাত্রের মৃত্যু

ঘুষ নিয়ে এএসআইয়ের দর-কষাকষির অডিও ভাইরাল

রাইসির খোঁজে যে ঘোষণা দিল এরদোয়ান

গণপিটুনির শিকার আ.লীগ নেতা

রাইসির খোঁজে এগিয়ে এসেছে যে সব দেশ

রাইসির খোঁজে ৩২ সদস্যের দল পাঠাচ্ছে তুরস্ক

১০

ইরানের প্রেসিডেন্টের দুর্ঘটনাস্থল থেকে মিলল সংকেত

১১

কেন এত সময় লাগছে অনুসন্ধানে

১২

টানা চারটি লিগ জয়ীদের এলিট ক্লাবে ম্যানসিটি

১৩

হেলিকপ্টার পাওয়ার বিষয়ে যা জানাল রেড ক্রিসেন্ট

১৪

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

১৫

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

১৬

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

১৭

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

১৮

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

১৯

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

২০
X