চলে গেলেন গরিবের ডাক্তার ফজলে রাব্বী মিয়া। বাচ্চু ডাক্তার নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। পাবনার নগরবাড়ী ঘাট এবং এর আশপাশের এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) গভীর রাতের বেদনা হয়ে তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। তার এই চলে যাওয়া একেবারে আকস্মিক নয়। বার্ধক্য তাকে ঘিরে ধরেছিল অনেক দিন আগেই। বেশ কিছুদিন ধরে তার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। তাই মনকে তৈরি করে নেওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবু শেষ হতে থাকা এবং শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কতটাই না তফাত। পরিণত বয়সেই মৃত্যু। তবুও মৃত্যু মানেই গভীর দুঃখবোধ, মৃত্যু মানেই হৃদয়ের গভীরে স্থায়ী শূন্যতা।
বাচ্চু ডাক্তার যখন স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, উনি বুঝি ভিনগ্রহের মানুষ ছিলেন। যেখানে মানুষের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি অতিমানবিক। বলা বাহুল্য, বাচ্চু ডাক্তারকে নিয়ে লেখার জন্য যে ঘন, সংহত, পরিচ্ছন্ন, সুস্পষ্ট ভাষা ও বর্ণনারীতি প্রয়োজন তা আমার নেই, আবার সীমাহীন দায়কে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও আমার নেই।
কতকগুলো দুঃখ আছে সামাজিক, কতগুলো দুঃখ নিতান্তই ব্যক্তিগত। ডা. ফজলে রাব্বী মিয়া উভয় দুঃখকেই জানতেন। সামাজিক দুঃখ তার উপলব্ধির মধ্যেই ছিল। কিন্তু জীবন পথের বাঁকে ওত পেতে থাকা ব্যক্তিগত দুঃখের আশঙ্কা তার জানা ছিল না। জীবনের মধ্যগগনে স্ত্রীর কবর তাকে খুঁড়তে হয়েছে নিজ হাতে। ডাক্তার হিসেবে তখন অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ ছিলেন তিনি। মানবিক দায়িত্ব পালনে নানা জায়গায় ছুটে যেতে হতো। স্ত্রী একা থাকতেন, তার প্রয়োজনের দিকে তিনি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে পারেননি। ধরেই নিয়েছিলেন স্ত্রী ভালো আছেন এবং ভালোই থাকবেন। কিন্তু তিনি থাকেননি, সহসা অনন্তলোকে চলে যান। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ডা. ফজলে রাব্বী মিয়া বিপত্নীক হন। তখন ছোট ছেলে মোমিনের বয়স ছিল মাত্র ৭ দিন। তার স্ত্রী মারা যান ডায়রিয়ায়। সেদিন তিনি চরের দুর্গম এক এলাকায় রোগী দেখতে গিয়েছিলেন। স্ত্রীর অসুস্থতা জেনে তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন আর কিছুই করার ছিল না। তিনি নিদারুণ দুঃখ পেলেন। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই নানাভাবে দুঃখ আসে। দুঃখ ছাড়া মানুষ হয় না। স্ত্রীর মৃত্যুতে ডা. ফজলে রাব্বী মিয়ার মধ্যেও একজন নিদারুণ দুঃখ পাওয়া মানুষ স্থান করে নেয়। তার ভেতরের সেই বেদনার্ত মানুষটিই তাকে নিরন্তর অতিলৌকিক মানুষ হিসেবে ধাবিত করে। নিজেকে তিনি এক অতিমানবিক মহাসমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। মহাবিশ্বে এর চেয়ে বড় সমুদ্র দ্বিতীয়টি নেই। এই সমুদ্রের ঢেউ শোষিত, বঞ্চিত, রিক্ত, নিঃস্ব, অসহায় মানুষ। দরিদ্র, অসহায় এসব মানুষ অবিরাম ক্লান্ত ঢেউয়ের মতো তার কাছে আছড়ে পড়েছে। তিনি পরম মমতায় তাদের সেবা করেছেন, সহযোগিতা করেছেন। নিজ পেশাকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। ডাক্তারি পেশাকে তিনি কখনোই অর্থ উপার্জনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেননি। উপরন্তু তিনি মানবিক বোধে এতটাই আচ্ছন্ন থাকতেন যে, রোগীকে সুস্থ করার দায়িত্ব নিয়ে নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করতেন দ্বিধাহীন চিত্তে।
ডা. ফজলে রাব্বী মিয়ার জীবনাচরণে প্রকাশ পেয়েছে দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের একজন আদর্শ চিকিৎসকের কর্তব্য ও মূল্যবোধের যথাযথ রূপ ও স্বরূপ। না, অলৌকিক নয়, লৌকিক মানুষ তিনি। জাগতিক মানুষ। সংসারের মধ্যেই ছিলেন। নিজ সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতেন, তাদের সাফল্য কামনা করতেন, সর্বতোভাবে তাদের সহযোগিতা করতেন। সংসার জীবনকে তিনি কখনো উপেক্ষা করেনি। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের বিপরীতে এই সাংসারিক দায়-দায়িত্ব তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেনি, তাকে শুষে নিতে পারেনি।
চিরদিনই অত্যন্ত শান্ত ও সংযত ছিলেন তিনি। কোনো রকম অনিয়ম বা উচ্ছৃঙ্খলতা তার স্বভাবে ছিল না। সামাজিক জীবনে আচার নিষ্ঠার বাড়াবাড়ি তার মধ্যে কখনো মুখ্য হয়ে ওঠেনি। তবে নিজেকে শুদ্ধ ও পবিত্র করার আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালনের ওপর ঝোঁক ছিল তার। নিয়মিত নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন। পরিচ্ছন্ন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। ছিলেন স্বচ্ছ মানবিক মূল্যবোধের মানুষ। তার বয়স যতই বেড়েছে, ততই এই বোধ আরও জোরালো হয়েছে। কেননা তিনি বৃত্তের ভেতর থাকতে প্রস্তুত ছিলেন না। বড় মানুষ তা করেন। বৃত্ত ভেঙে ফেলেন এবং বৃত্তের বাইরে বিচরণ করেন। তিনিও তা-ই করেছেন। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে তিনি অগণিত অসহায়, গরিব মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন।
আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষিতে ডাক্তারদের দোষ দেওয়ার উপায় নেই। সমাজের আর দশজনের মতো তারাও মানুষ। চাকরি এবং ব্যবসার মতো ডাক্তারিটা অধিকাংশের নিছক পেশা। যেসব বিশ্বাস এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে তারা সমাজে বসবাস করেন, সেসব নিয়েই তারা ডাক্তারি করেন, পয়সার জন্য। ডাক্তারি তাদের জীবনে আদর্শ বা ব্রত হয়ে উঠতে পারে না। তবে সবাই এক নন। ব্যতিক্রম আছে হয়তো।
আমাদের গ্রামে এখন অনেক বড় বড় ডাক্তার আছেন। তাদের নামের শেষে দুর্বোধ্য বড় বড় ডিগ্রি আছে। ডাক্তার হিসেবে তাদের অনেক নামডাক আছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে বাচ্চু ডাক্তারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন, এমন ডাক্তার নেই। ডাক্তার তো দূরের কথা, অন্য শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যেও নেই।
ডা. ফজলে রাব্বী মিয়া ছিলেন সত্যিকারের ডাক্তার। দুই ধরনের রোগকেই তিনি জানাতেন। প্রথমত সমাজের, দ্বিতীয়ত ব্যক্তি মানুষের। সমাজ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, আর মানুষ দরিদ্র। অতিকষ্টে চলে তাদের সংসার। চিকিৎসক জীবনের গোড়াতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষ কেবল দেহের রোগেই ভোগে না, সামাজিক কুসংস্কার এবং দারিদ্র্য মানুষকে দুরারোগ্য রোগের মতোই ভোগায়। এই সমাজের অধিকাংশ মানুষ যত না রোগ-ব্যাধিতে পীড়িত, তার চেয়ে বেশি এরা অভাব-অনটনে নিপীড়িত। রোগ-শোক থেকে এদের মুক্তি মেলে বটে। কিন্তু অভাবের যন্ত্রণা থেকে তাদের কখনোই মুক্তি মেলে না, মরণব্যাধি অভাবের সঙ্গে তাদের স্থায়ী বসবাস। এই সত্য তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সেইসঙ্গে জীবনকে তিনি নতুন রূপে দেখতে পেয়েছিলেন। এই রূপ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা লোভ-লালসার নয়। এই রূপ এক অতিলৌকিক মানবিক মূল্যবোধের। এই বোধের কাছে অর্থাৎ দরিদ্র-নিপীড়িত মানবতার সেবার কাছে তার সকল জাগতিক চাওয়া-পাওয়া তুচ্ছ হয়ে যায়।
আমাদের কৈশোরে দেখেছি, প্রতিদিন ভোর থেকে নগ্ন পায়ে রোগীরা ছুটতেন বাচ্চু ডাক্তারের বাড়ির দিকে। বহু দূরের গ্রাম থেকে মেঠোপথ ধরে, খাল বিল নদী পার হয়ে যেতেন তার কাছে। সব পথ যেন চলেছে ওই দিকে। মুখগুলো মলিন ও বিবর্ণ। কারও মুখে মৃত্যুভয় আঁকা, কারও মুখে মরণের চিহ্ন। অজানা-অচেনা এই মানুষগুলোকে বড়ই আপন ভাবতেন তিনি। তাদের চিকিৎসা করতেন গভীর মমতায়। রোগীরা তাকে কোনো ফি দিতেন না। পাওয়ার আশাও তিনি করতেন না। উল্টো রোগীদের তিনি কীভাবে ওষুধ-পথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন, সেই চিন্তায় সর্বদা মগ্ন থাকতেন। প্রায় ২০ বছর আগে একবার কীভাবে যেন তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল। সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখার প্রয়োজন কারও বোধের মধ্যেই ছিল না। জনতার স্রোত আছড়ে পড়েছিল তার বসতবাড়িতে। সড়ক যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন উত্তরবঙ্গের গাড়িগুলো নগরবাড়ী ঘাট হয়ে ঢাকা যেত।
শিশুদের প্রতি তার ছিল সীমাহীন মমতা। স্থানীয় বাজারের মসজিদে তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। আসরের নামাজের সময় তার আগমনের অপেক্ষায় মসজিদের পাশে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো প্রায় দু ডজন ছেলেমেয়ে। উনি নামাজ শেষ করে বের হতেই ওরা তার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করত। তিনি মসজিদের অদূরে নাটিয়াবাড়ি বাজার সংলগ্ন ব্রিজের সামনে এসে ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেন এবং সবাইকে দুই টাকা করে দিতেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি একগাল নির্মল হাসি দিয়ে বলতেন, ‘প্রতিদিন দু-এক টাকা ওদের দিই। সেজন্য আসে। ওরা তো খুব গরিব।’
শুধু গরিব, দুঃখী মানুষ নয়! রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর জন্য তার মমতার অন্ত ছিল না। ফজরের নামাজের পর উনি মসজিদ থেকে বের হতেই বেশ কয়েকটি কুকুর তার পিছু নিত। তিনি কুকুরগুলোকে রুটি, বিস্কুট বা মাংসের টুকরো খাওয়াতেন। ডা. ফজলে রাব্বী মিয়ার অনুপস্থিতিতে এলাকার গরিব মানুষ আরও গরিব হয়ে গেল। আরও অসহায়, রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে গেল। তাদের শেষ ভরসার জায়গাটুকুও আর রইল না...
জাকির হোসেন: লেখক ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন