২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করে রাশিয়া। হামলার পর থেকেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। হামলার নিন্দা, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়াবিরোধী প্রচারণা এবং মানবাধিকার প্রশ্নে সমগ্র বিশ্বকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একত্রিত করার চেষ্টা চালাতে থাকে পশ্চিমা জোট। জাতিসংঘের হিসেবে ইউক্রেন সংঘাতের প্রথম ২১ মাসে ৫৬০ শিশুসহ প্রায় ১০ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ আমেরিকান ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের প্রত্যেকে রাশিয়ান সেনাদের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। অথচ ফিলিস্তিনের গাজায় চালানো ইসরায়েলি বর্বরতায় তারা নীরব।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে গাজায় চতুর্মুখী হামলা শুরু করে ইসরায়েল। মাত্র ১০০ দিনে ইসরায়েল কমপক্ষে ২৬০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষ, আহত হয়েছে ৬৩০০০ এরও এরও বেশি ফিলিস্তিনি। অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। নিহত এবং পঙ্গুত্ব বরণ করা ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।
গাজায় যেভাবে বেসামরিক জীবন এবং অবকাঠামোর ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা অতীতের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ইউক্রেন, আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরিয়ার মতো যুদ্ধেও এভাবে ব্যাপকভাবে বেসামরিক মানুষকে টার্গেট করা হয়নি। জাতিসংঘের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এমন ভয়াবহতা আর কোথাও দেখা যায়নি।
পশ্চিমাদের দ্বৈতনীতি
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বরতায় নিরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা। তারা শুধু ইসরায়েলের নৃশংস কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতাই দেয়নি, বরং গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্রও সরবরাহ করেছে তারাই। কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েলের হামলাকে বৈধতাও দিয়েছে তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা তাদের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলোও বাতিল করে দিয়েছে।
ইসরায়েলের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োগ করা এই দ্বৈতনীতি কোনো ব্যতিক্রমী উদাহরণ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নীতি শুধু তাদের দেশ, জনগণ ও সংস্কৃতির পক্ষে। স্বার্থের জন্য তারা হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ হত্যাকে বৈধতা দেয় আবার কোথাও নিজেদের স্বার্থ সামনে এসে পড়লে তখন প্রতিবাদ করে। তাদের এই নীতি সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিগুলির উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা।
নিজেদের ‘উচ্চতর’ সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ প্রদর্শনের জন্য পশ্চিমারা তাদের চিরাচরিত পদ্ধতি অবলম্বন করে। তারা গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, স্বাধীনতা, প্রতিনিধিত্বকারী সরকার এবং অধিকারের প্রতি তার অদম্য বিশ্বাসের উচ্চবাক্য ব্যবহার করে। তারা ভিন্নমত ও বৈচিত্র্যের প্রতি লোকদেখানো শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। যখনই এই নীতি এবং আদর্শগুলো গ্লোবাল সাউথের ওপর তার আধিপত্যের পথে বাধা সৃষ্টি করে বা তাদের স্বার্থকে সংকীর্ণ করে তখনই তাদের আদর্শ এবং নীতিগুলো অন্ধ হয়ে যায়।
পশ্চিমারা তাদের সমাজে উদারনৈতিক মূল্যবোধ দেখিয়ে তা উদযাপন করে কিন্তু সেই উদারনৈতিক মূল্যবোধের সর্বজনীন প্রসারে তারা ইচ্ছুক নয়। তারা সারা বিশ্বের মানুষের জাতিগত শ্রেণিবিন্যাসের সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে বেছে বেছে তাদের প্রচার করে। ইসরায়েলকে তারা এভাবেই বেছে নিয়েছে এবং ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে ফিলিস্তিন প্রশ্নে তাদের দৃষ্টি এবং বিবেক অন্ধ।
উপনিবেশবাদের নতুন মুখ ইসরায়েল
ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটি এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডে একটি বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে। ১৯৪৮ সালে এই দখলদার রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তখন থেকেই বিভিন্ন কৌশলে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা, তাদের প্রত্যাবর্তন অস্বীকার করা, ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন এলাকা এবং মসজিদগুলো বাজেয়াপ্ত করাসহ ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চলতে থাকে। যে নিপীড়নের শেষ আজও হয়নি।
ফিলিস্তিনের অর্ধেকের বেশি মানুষকে একপ্রকার বন্দি রেখে, ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে দেয়াল টেনে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের চলাফেরাকে সংকীর্ণ করে, সারাক্ষণ তাদের নজরদারির মধ্যে রেখে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি সামরিক শাসন জারি করে রেখেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের ওপর চালানো এই বৈষম্যগুলো অন্যায়ভাবে আইনগত বৈধতাও দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা আইডি সিস্টেম, শুধু ইহুদিদেরকে বাড়ি নির্মাণের অনুমতি, ফিলিস্তিনিদের নিজ বাড়ি ও সম্পত্তি থেকে বের করে দিয়ে তা দখল করে ইহুদিদেরকে দেওয়া, একই জায়গায় ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য পৃথক রাস্তা নির্মাণসহ নানা ধরনের অত্যাচার চালানো হয় ফিলিস্তিনিদের ওপর। পশ্চিম তীরে শত শত সামরিক চেকপয়েন্ট বসানো, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের চারপাশে বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর তৈরি করে ফিলিস্তিনিদের সস্তা শ্রম হিসেবে ব্যবহার করা, বিবাহ আইন, নাগরিকত্ব এবং ইহুদি জাতীয়তা আইন পাস, জেরুজালেমের ক্রমাগত ইহুদিকরণ এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অধিকার অস্বীকারসহ একটি বৈষম্যমূলক আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে সেখানে।
গত ১৬ সপ্তাহ ধরে গাজার জনগণের ওপর গণহত্যামূলক এবং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েল। কিন্তু এর আগে আরও ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজার ওপর যে পঙ্গুত্বের অবরোধ আরোপ করেছে তার কোনো শেষ নেই।
কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের প্রয়োগ করা এই ধরনের কৌশলগুলোর সঙ্গে অতীতের দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ শাসনের দিকগুলোর অনেক মিল পাওয়া যায়। ইসরায়েলের এই দখদারিত্ব আন্তর্জাতিক ও মানবিক আইনের বিপরীতে নব্যঔপনিবেশিকতার নির্লজ্জ রূপ এবং একটি ইসরায়েলি বর্ণবাদ ব্যবস্থার পরিষ্কার চিত্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা যে গভীর বর্ণবাদী ইসরায়েল প্রশ্নে তা আর ঢাকা থাকে না। অ-পশ্চিমা জনগণের প্রতি তাদের গভীর বর্ণবাদী মনোভাবের কারণে তারা ইসরায়েলের নিপীড়ক শাসনকে স্বীকার করতে পারে না। তারা শুধু এক পক্ষকে মানুষ হিসেবে, এক পক্ষকে যোগ্য সহানুভূতি এবং সমর্থনের যোগ্য হিসেবে দেখে এবং এখানে তাদের কোনোরকম অনুযোগ বা অপরাধবোধ নেই।
ড. সামি এ. আল আরিয়ান : ইস্তাম্বুল জাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স (সিআইজিএ) এর পরিচালক। ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন