সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ‘অলআউট’ আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। অবস্থান কর্মসূচি থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই আন্দোলনে আর কোনো ভুল করতে চায় না দলটির হাইকমান্ড। কর্মসূচি বাস্তবায়নে সৃষ্ট সমন্বয়হীনতা এখনই কাটিয়ে উঠতে চায়। কারণ, সমন্বয়হীনতার কারণে ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি সফল হয়নি বলে বিএনপির মূল্যায়নে উঠে এসেছে। দলটির মূল্যায়ন, নেতাকর্মীরা সেভাবে রাজপথে না নামায় কর্মসূচি পুরোপুরি সফল হয়নি। তবে পুলিশ ও সরকারি দলের মারমুখী অবস্থান এবং দোলাইরপাড়ে কর্মসূচিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনায় সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি ওইভাবে সামনে আসেনি। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমসহ মানুষের কাছে গয়েশ্বরের ওপর হামলার ঘটনাটিই ফোকাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত বিএনপির মুখ রক্ষা হয়েছে। গত সোমবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে নেতাদের এমন মূল্যায়ন উঠে আসে। অবস্থান কর্মসূচির পর এটিই ছিল নীতিনির্ধারকদের প্রথম বৈঠক।
এদিকে অবস্থান কর্মসূচির মূল্যায়নে গত কয়েকদিনে দলের বিভিন্ন ফোরামের নেতাদের সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির হাইকমান্ডের ভার্চুয়ালি বৈঠক হয়েছে। সেখানেও গয়েশ্বর রায়সহ কিছু নেতার ওপর পুলিশি হামলার কারণে কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি সেভাবে ফুটে ওঠেনি বলে মূল্যায়নে উঠে এসেছে।
জানা যায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একদফার যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে আগামী শুক্রবার ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে ঢাকার বাইরে আপাতত কর্মসূচি হচ্ছে না। এরই মধ্যে যুগপতের শরিকদের এ কর্মসূচির বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজকালের মধ্যে যুগপৎভাবে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কর্মসূচি প্রণয়নে কয়েকদিন ধরে যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে বিএনপি। সর্বশেষ ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে ৫ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি করে বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, একদফার যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি শিগগির ঘোষণা করা হবে।
একদফা দাবি আদায়ে ঢাকায় ২৮ জুলাই মহাসমাবেশের পরদিন রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি দেয় বিএনপি। সফল মহাসমাবেশের পর এমন কঠোর ও সাংঘর্ষিক কর্মসূচি নিয়ে নেতাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। কোন বিবেচনায় এবং কীভাবে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, নেতাকর্মীদের কাছে তা স্পষ্ট ছিল না। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ নেতাও আগে থেকে এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। ফলে কর্মসূচি বাস্তবায়নে আগে থেকে সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। এতে সমন্বয়নহীনতার বিষয়টি সামনে আসে। কারণ, ঢাকার পাঁচটি প্রবেশপথে স্থায়ী কমিটির কোন সদস্য কোথায় থাকবেন, সেটা গভীর রাতে তাদের জানানো হয়। ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য নেতারা কে কোথায় থাকবেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা তা জানতে পারেননি। সে কারণে কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা সেভাবে নামতে পারেননি। ফলে কর্মসূচি সফল হয়নি। ঢাকার বাইরে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতাকে অবস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়।
বিএনপির হাইকমান্ড মনে করে, ঢাকার প্রবেশপথের প্রতিটি পয়েন্টে ২৫ থেকে ৩০ হাজার নেতাকর্মী জড়ো হওয়া সম্ভব ছিল। কারণ, ২৮ জুলাইয়ের মহাসমাবেশ ঘিরে সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মী তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। আর প্রতিটি পয়েন্টে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জড়ো হলে পুলিশ এমন মারমুখী ভূমিকায় যেতে পারত না। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। আন্দোলনের গতিপথও পাল্টে যেত। দলটির পরিকল্পনা ছিল, ঢাকায় অবস্থানরত নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত করে ঢাকাকেন্দ্রিক ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছানো। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী, নেতাকর্মীরা বেশ কিছুদিন ঢাকায় অবস্থানের প্রস্তুতি নিয়ে মহাসমাবেশেও এসেছিলেন।
সাংগঠনিক ব্যর্থতায় অবস্থান কর্মসূচি সফল না হওয়ার পাশাপাশি ওই কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেওয়া হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হঠাৎ চাপে পড়ে বিএনপি। সে কারণে বাধ্য হয়ে আন্দোলন কৌশলে পরিবর্তন আনে। ৩১ জুলাই জেলা ও মহানগরে প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের নিজ জেলায় ফেরত পাঠানো হয়।
এদিকে অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাদের ভূমিকায় হাইকমান্ড খুবই নাখোশ। কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি বিএনপির হাইকমান্ডের কাছেও ধরা পড়ে। তা ছাড়া কর্মসূচিতে জ্যেষ্ঠ নেতাদের রাজপথে না নামা এবং অবস্থান কর্মসূচি থেকে একটি অঙ্গসংগঠনের একজন শীর্ষ নেতার হঠাৎ প্রস্থানকেও ভালোভাবে নেয়নি দল। আগামীতে কর্মসূচি বাস্তবায়নে দ্রুত এ সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে উঠতে চায় বিএনপি।
বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানসহ নেতাদের সাজা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দলটি মনে করে, সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে বিএনপিসহ বিরোধী দল দমনের চেষ্টা করছে। বিএনপিকে বাইরে রেখে আবারও একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটছে সরকার। এ কারণে নেতাদের বিভিন্ন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, দ্রুত সাজা দেওয়া হচ্ছে। এখন থেকে এ বিষয়টি নিয়ে আরও সোচ্চার হবে বিএনপি। বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, সেমিনারে বক্তব্য ও বিবৃতির মধ্য দিয়ে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
মন্তব্য করুন