জলবায়ু অর্থায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ সম্মেলন শুরু হয়েছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, প্যারিস চুক্তির অধীনে জলবায়ু অর্থায়ন অভিযোজন এবং বৈশ্বিক মূল্যায়নের (গ্লোবাল স্টকটেক) ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি আসবে। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট সমাধানের লক্ষ্যে কপ-২৯-এ প্রায় ২০০ দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা একত্র হবেন। এবারের সম্মেলনের মূল লক্ষ্য জলবায়ু সংকটের ভুক্তভোগী দরিদ্র দেশগুলোকে আরও অর্থসহায়তা দেওয়ার পথ খুঁজে বের করা।
গতকাল সোমবার কপ সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সঙ্গে আজকের চরম আবহাওয়ার প্রভাব মোকাবিলা করতে প্রতিদিন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। তারা আসলে যা পাচ্ছে তা তার দশমাংশেরও কম, দিনে প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ডলার।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে কঠোর ভাষায় বলেছেন, ‘জলবায়ু বিপর্যয় নতুন বাস্তবতা এবং আমরা এ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছি না। জলবায়ু সংকট এখানেই এবং আমরা সুরক্ষা গ্রহণকে পিছিয়ে দিতে পারি না। আমাদের মানিয়ে নিতে হবে এবং সেটা এখনই।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, যখন অভিযোজন তহবিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পড়ছে, তখন এসব ধ্বংসের উদ্যোক্তারা—বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প—ব্যাপক মুনাফা করছে এবং ভর্তুকি কমাচ্ছে।
ইউএনইপি রিপোর্টের প্রধান গবেষক হেনরি নিউফেল্ড বলেছেন, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো যখন অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি পাচ্ছে—২০২১ সালে ২২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ২৮ বিলিয়ন ডলার, তখন জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাবগুলো আরও দ্রুত বাড়ছে।
শীর্ষ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট মুখতার বাবায়েভ কপ-২৯-কে ‘প্যারিস চুক্তির জন্য সত্যের মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা ধ্বংসের পথে আছি, তবে এগুলো ভবিষ্যতের সমস্যা নয়। জলবায়ু পরিবর্তন এরই মধ্যে আমাদের সামনে উপস্থিত। তিনি মনে করেন, কপ-২৯ হলো সবার জন্য একটি নতুন পথের সূচনার অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত।
জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, তিনি (স্টিয়েল) গ্রেনাডা দ্বীপের ক্যারিয়াকাউ থেকে এসেছেন, যা জুলাই মাসে হারিকেন বেরিল দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছিল। স্টিয়েল তার বয়স্ক প্রতিবেশী ফ্লোরেন্সের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের একটি ছবি দেখান। ফ্লোরেন্সের বাড়ি ঝড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জলবায়ু সংকট বিশ্বের প্রতিটি একক ব্যক্তিকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে, জ্বালানি শক্তির বিল বাড়িয়ে দিচ্ছে, বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং জীবন কেড়ে নিচ্ছে বলে স্টিয়েল মনে করেন। কপ-২৯-এ প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে নতুন বিশ্বের আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে, কার্বন বাজারের নিয়মগুলো চূড়ান্ত করা হবে এবং দূষণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে বলে স্টিয়েল উল্লেখ করেন।
আজারবাইজান থেকে আগত কপ প্রেসিডেন্ট মুখতার বাবায়েভকে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়ে আরব আমিরাতের বিদায়ী কপ প্রেসিডেন্ট সুলতান আল জাবের বলেন, কাজকে কথার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিন। ইতিহাস আমাদের কাজ দিয়ে বিচার করবে, আমাদের কথা দিয়ে নয়।
গ্লোবাল উইটনেসের জ্যেষ্ঠ জীবাশ্ম জ্বালানি তদন্তকারী প্যাট্রিক গ্যালি বলেন, জলবায়ু সংকট প্রতিবছর আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মনে হচ্ছে, প্রতিবছর আমাদের আরেকটি জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি জলবায়ু আলোচনাকে ব্যবহার করছে আরও বেশি তেল ও গ্যাস চুক্তির জন্য। যে দুর্বল দেশগুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি পথ সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে কপের ওপর নির্ভর করছে, সেখানে স্টেট অয়েল কোম্পানি (সোকার) বিদেশি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ২৫টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সোকারের লক্ষ্য কয়েক দশক ধরে প্রচুর পরিমাণে তেল এবং গ্যাস উৎপাদন করা, যা সরাসরি জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনার বিবৃত লক্ষ্যের বিরোধী। স্বার্থের এই দ্বন্দ্ব জলবায়ু ভাঙন রোধের দিকে অগ্রগতি হ্রাস করছে। বড় দূষণকারীদের এই আলোচনায় স্থান দেওয়া উচিত নয়। অনেক দেরি হওয়ার আগে আমাদের অবশ্যই তাদের এই আলোচনা থেকে বের করে দিতে হবে।
কার্বন ব্রিফের ডা. সাইমন ইভান্সের মতে, কয়েকটি বিতর্কিত বিষয় রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইইউ-এর সিবিএএম (কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম) যা এক ধরনের কার্বন শুল্ক, যা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে এবং গত বছর একে এজেন্ডায় নেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
এক সংবাদ সম্মেলনে জলবায়ু এনজিও অয়েল চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের সহ-ব্যবস্থাপক অ্যালি রোজেনব্লুথ বলেন, জলবায়ু আন্দোলনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন ‘ভয়াবহ’ সংবাদ। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে কয়েক ডজন পরিবেশগত বিধি প্রত্যাহার করেছিলেন। তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়েছিলেন, যা তিনি আবার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্পের আসন্ন ভূমিকা মার্কিন জলবায়ু কর্ম পরিকল্পনা এবং জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিতে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রোধে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ তাদের বর্তমান আবাসস্থল থেকে স্থানান্তরিত হবে এবং ২০৮০ সালের মধ্যে দেশটির ১৩ শতাংশ উপকূলীয় এলাকা সমুদ্রের পানির নিচে হারিয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা বাংলাদেশকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেবে; কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেনি। ২০১৫ সাল থেকে দেশটি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হলেও এই বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উৎস থেকে মাত্র ৭১০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে যা প্যারিস কপে প্রতিশ্রুতিকৃত অর্থের মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। তবে ২০২৩ সালে দুবাইতে অনুষ্ঠিত কপ-২৮-তে আমরা যে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের আশ্বাস পেয়েছি যেটি থেকে ২০২৬ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে অর্থায়ন করা হবে সেই অঙ্গীকারের কার্যকর প্রতিফলন আমরা এই কপ থেকে পেতে পারি। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড পাওয়ার জন্য যেসব প্রয়োজনীয় পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে, সেই পদক্ষেপ আমরা এই কপ থেকেই পাব বলে আমার বিশ্বাস।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা হলো কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ)। ১৯৯২ সালে রিও সম্মেলনে ইউএনএফসিসিসি গঠনের পর থেকে প্রতি বছর কপের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা প্রতিক্রিয়ার অগ্রগতি যাচাই করা হয়, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই সম্মেলনগুলো প্রত্যেকটি দেশকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসে। ১৯৯৫ সালের ২ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল জার্মানির বার্লিনে প্রথম কপ-১ কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যৌথ উদ্যোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কপ-২১ সম্মেলনটিতে ১৯৬টি দেশের মতামতের ভিত্তিতে প্যারিস চুক্তির সুপারিশ হয়। ওই চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০৩০ সালে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন প্রায় ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কীভাবে কার্বন নির্গমন শূন্যের কোঠায় নেওয়া যায়, সেই বিষয় আলোচনায় স্থান পায়। তারই ধারাবাহিকতায় দুবাইতে ঐতিহাসিক কপ-২৮-এ আমরা লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের আশ্বাস পেয়েছি যেটি থেকে ২০২৬ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে অর্থায়ন করা হবে।