রাজকুমার নন্দী
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫০ এএম
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব কষছে বিএনপি

একদফার আন্দোলন
ছবি: কালবেলা গ্রাফিক্স
ছবি: কালবেলা গ্রাফিক্স

মিত্রদের নিয়ে একদফা দাবিতে বছরের অধিককালব্যাপী রাজপথে আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব করছে বিএনপি। এ নিয়ে শরিকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে দলটি। শরিকদের মূল্যায়নসহ নিজেদের মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা শেষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপি।

জানা গেছে, নিস্তেজ হয়ে পড়া সরকারবিরোধী আন্দোলন আবার চাঙ্গা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে এ মুহূর্তে জোরালো কোনো আন্দোলনে যাচ্ছে না দলটি। কখন থেকে তা শুরু হবে, সে ব্যাপারেও এখনো কংক্রিট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আপাতত জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। তবে আগামী দিন দশেকের মধ্যে যুগপৎভাবে কোনো কর্মসূচি থাকছে না। অবশ্য এই সময়ের মধ্যে দলীয় ও জোটগত কর্মসূচি পালন করা হবে। আগামী ১৯ জানুয়ারি দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৮তম জন্মদিন উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি নিতে পারে বিএনপি।

দেখা গেছে, আত্মগোপন অবস্থা থেকে দলটি এখন স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশে ফিরছে। এর অংশ হিসেবে ৭৫ দিন পর গত বৃহস্পতিবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলেছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে কিছু নেতাকর্মী তালা ভেঙে দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। নেতাকর্মীদের পদচারণায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় ক্রমেই সরব হয়ে উঠছে। সারা দেশের জেলা কার্যালয়গুলোও খোলা শুরু হয়েছে। হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন থাকা নেতাকর্মীরাও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন। কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে দল। এরই মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। তবে তার বিরুদ্ধে আরও মামলা রয়েছে। পরিস্থিতি আরও একটু স্বাভাবিক হলে ঢাকায় সমাবেশের মতো কর্মসূচি দিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরুর পরিকল্পনা করছে বিএনপি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মতামত নিচ্ছে বিএনপি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে গত মঙ্গলবার ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। তবে এই মুলতবি বৈঠক আগামী ১৮ জানুয়ারির পর আবার হবে। প্রাথমিক মূল্যায়নে, আন্দোলনের ফসল ঘরে না তুলতে পারাকে ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছে বিএনপি ও শরিকরা।

সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ৪০টির মতো দল এবং চারটি জোট সম্পৃক্ত থাকলেও প্রধান শরিক বিএনপির কাছে গণতন্ত্র মঞ্চের গুরুত্ব সর্বাধিক হিসেবে বিবেচিত। মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে বৈঠক করে বিএনপি। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে প্রথমে দলটির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য এবং পরে স্থায়ী কমিটি ও হাইকমান্ডের বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে তারেক রহমান ছাড়াও ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু সশরীরে এবং ভার্চুয়াল মাধ্যমে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ূম ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ছিলেন।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা প্রসঙ্গে কমপক্ষে পাঁচটি এজেন্ডা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেখানে বিএনপি জোটের আহ্বানে জনগণের ভোট বর্জন করাকে আন্দোলনের ‘নৈতিক বিজয়’ হিসেবে দেখা হলেও রাজপথের আন্দোলন কেন চূড়ান্ত সফলতা পেল না, কোথায় কোথায় ঘাটতি ছিল, তা নিয়ে আলোচনা হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেন। তারা বলেন, হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে জনগণ তাদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। সে কারণে দীর্ঘ সময় ধরে দূরপাল্লার যানবাহন চলেনি। কিন্তু কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাকর্মীরা সেভাবে রাজপথে নামেননি, ঝটিকা মিছিলে বিক্ষিপ্তভাবে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরে মঞ্চের নেতারা বলেন, কঠিন সময়েও ঝুঁকি নিয়ে তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাঠে ছিলেন। কিন্তু কর্মসূচি সফলে বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যাপক হারে মাঠে নামা দরকার ছিল। কারণ, সারা দেশে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। ঘরে বসে গ্রেপ্তার না হয়ে রাজপথ থেকে গ্রেপ্তার হলে আন্দোলন অন্য মাত্রা পেত। ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের পরদিন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখে ‘অবস্থান’ এবং হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা প্রত্যাশিত হারে নামলে আন্দোলনের গতি পাল্টে যেত।

বৈঠকে কর্মসূচি প্রণয়নে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি তুলে ধরে মঞ্চের নেতারা বলেন, আন্দোলনের শেষদিকে তাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যুগপৎভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া কর্মসূচি প্রণয়নের প্রক্রিয়াও যথাযথ ছিল না। সব জোট ও দলের লিয়াজোঁ কমিটির সব নেতার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ আরও অন্য ফোরামে আলোচনার পর কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা এই সমন্বয়হীনতা দূরীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা আগামীতে যুগপতের প্রতি জোট থেকে শুধু সমন্বয়ক এবং বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির দু-তিনজনের সমন্বয়ে বৈঠক থেকেই কর্মসূচি প্রণয়নের প্রস্তাব করেন। বিএনপি এ বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে বৈঠকে জানায়।

এ ছাড়া বৈঠকে যুগপতের ভিত্তি হিসেবে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা ‘৩১ দফা’-কে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটিকে এখন ব্যাপক পরিসরে জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। নেতারা বলেন, সরকার ও সরকারি দল দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনকে জ্বালাও-পোড়াওয়ের আন্দোলন এবং আন্দোলনের কোনো লক্ষ্য ও ক্ষমতাসীন হলে মানুষের জন্য কোনো ভিশন না থাকার কথা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছে। অথচ ৩১ দফায় যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্য ও ভিশনের কথা সুস্পষ্টভাবে আছে। কিন্তু এটিকে আমরা দেশ-বিদেশে সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি।

বৈঠকে ভৌগোলিকসহ নানা কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে গণতন্ত্র মঞ্চ। মঞ্চের নেতারা বলেন, নতুন করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। বিএনপিকে প্রয়োজনে এ প্রক্রিয়ায় নতুন নেতাদের সংযুক্ত করতে হবে এবং এখনই এই প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। একই সঙ্গে রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রসঙ্গত, চূড়ান্ত আন্দোলনের শেষদিকে এসে বক্তব্য-বিবৃতির মধ্য দিয়ে ভারতবিরোধী অবস্থান জোরালো করতে বিএনপির পক্ষ থেকে যুগপতের শরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় এবং সে অনুযায়ী, শরিকরাও ভারতবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন।

বৈঠকে কূটনীতিক ব্যর্থতা নিয়েও আলোচনা হয়। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, বিএনপি একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু আন্দোলন ও নির্বাচন সামনে রেখে প্রভাবশালী দু-একটি দেশের কূটনীতিক ছাড়া অন্যদের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক বিশ্বের জোরালো চাপও আসেনি। আগামী দিনে এই কূটনৈতিক ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হবে।

বৈঠকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের আগে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপির ‘ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের’ উদ্যোগের বিষয়টিও আলোচনায় আনে গণতন্ত্র মঞ্চ। মঞ্চের নেতারা বলেন, ৩১ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু ও পরিচালিত হয়, সেখানে জামায়াত ছিল না। তারপরও জামায়াতকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আন্দোলনের স্বার্থে জামায়াতকে যুগপতে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে আমাদের তেমন আপত্তি না থাকলেও একমঞ্চে আপত্তি ছিল। জামায়াত ইস্যুতে গণতন্ত্র মঞ্চের অবস্থান একই রয়েছে। জানা যায়, বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের দেওয়া প্রস্তাবগুলো লিপিবদ্ধ করে বিএনপি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো মতামত দেয়নি।

জানা যায়, বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের দেওয়া প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করে বিএনপি। তবে অভিযোগের ক্ষেত্রে কোনো মতামত দেওয়া হয়নি।

বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আন্দোলনের একপর্যায়, এরপর থেকে আরেক পর্যায়। আমরা ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছি। আমাদের ডাকে জনগণ একতরফা, ডামি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। এই প্রত্যাখ্যান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন জনগণের এই গণপ্রত্যাখ্যানকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী আন্দোলনের সূচনা করা যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। তিনি আরও বলেন, বৈঠক মুলতবি রয়েছে। শিগগির আবারও বৈঠক হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বরখাস্ত এসআইকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

ছেলেদের কাছে ৪৯ রানে ধরাশায়ী হয়ে অলআউট মেয়েরা

চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত

নতুন মাইলফলক / এমআইই পাথওয়েজের প্রথম এনসিইউকে গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি উদযাপন

বলিউড ছেড়ে দক্ষিণে দিব্যা দত্ত

প্রোটিয়া টি-টোয়েন্টি দলে ফিরলেন মহারাজ-মিলার

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু

স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা, জামিন দেওয়ায় বাদীর ক্ষোভ

রাশিয়ার পারমাণবিক প্লান্টে আগুন

এশিয়া কাপের জন্য শক্তিশালী দল ঘোষণা করল বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ

১০

মেডিকেলে ‘আনফিট’ রিপোর্টে ভেঙে গেলে নবদম্পতির সংসার

১১

যুদ্ধ সক্ষমতা ও বিশেষ প্রযুক্তি দেখাল উত্তর কোরিয়া

১২

জঙ্গলে রহস্যময় জ্বলন্ত গাড়িতে পাওয়া গেল ২ পুরুষের মরদেহ

১৩

ডাকাতি করে পালানোর সময় ২ জনকে গণপিটুনি

১৪

দুঃসময় যেন পিছুই ছাড়ছে না পাক তারকা ক্রিকেটারের, এবার যেন হারাবেন পদটাই

১৫

হাই ব্লাড প্রেশার নিয়ে যা জানা জরুরি

১৬

বিপাকে স্বরা ভাস্কর

১৭

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৮

মাঝ আকাশে নগ্ন অবস্থায় ধরা বিমানবালা

১৯

মরদেহ দাফনের পর জীবিত ফিরে এলো রবিউল!

২০
X