দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি সেচ প্রকল্প হলো গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প বা জিকে প্রকল্প। কুষ্টিয়াসহ চার জেলার প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দিতে জিকে সেচ প্রকল্প চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের সেচ খরচ কমার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়ও কমেছিল। সম্প্রতি সবকটি পাম্প নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভরা মৌসুমেও পানি পাননি কৃষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের তিনটি প্রধান পাম্পের মধ্যে দুটিই নষ্ট। সম্প্রতি তৃতীয় পাম্পটিও অকেজো হয়ে পড়েছে। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি চুরি হয়ে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় সেচের পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের সবকটি পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে অনেক কৃষক ধানের চারা রোপণ করতে পারেননি।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আগেই দুটি পাম্প বিকল হয়। সচল পাম্পটিও গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বিকল হয়ে যায়। এতে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তবে দ্রুতই পাম্পগুলো সচলে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জিকে প্রকল্পের মতোই কুমিল্লার দাউদকান্দির সুন্দলপুর সেচ প্রকল্পের পাম্প হাউসে স্থাপিত ১০টি পাম্পের সব বন্ধ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল সেচ প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ৭৮টি পাম্প দিয়ে চাষাবাদের জন্য পানি সরবরাহ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের অভাবে এখন মাত্র ১১টি পাম্প সচল রয়েছে।
এদিকে, মৌলভীবাজার মনু নদী সেচ প্রকল্প থেকেও এ বছর সঠিক সময় সেচের পানি পাননি কৃষক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩৮ বছরেও মনু নদী সেচ প্রকল্পের খনন কাজ না হওয়ায় অচল হয়ে গেছে সেচ খাল। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ আহমদ বলেন, প্রতি বছর আমাদের বাজেট স্বল্পতার কারণেও সব খাল খনন করা সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে, ৬৩ কোটি ২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত মাতামুহুরী সেচ প্রকল্পের পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছেন না কৃষক ও স্থানীয়রা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি বছর ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ড্যাম সংস্কার হয়নি। রাবার নষ্টের বিষয়টি স্বীকার করে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, ইতোমধ্যে একটি দল রাবার ড্যাম প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন।
শুধু এগুলো নয়, দেশের বেশিরভাগ সেচ প্রকল্পের অবস্থা প্রায় একই রকম। রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে পাম্পসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া নতুন এবং পুনর্বাসন প্রকল্প না নেওয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে খাল খনন না হওয়ায় অচল হয়ে গেছে অনেক সেচ খাল। বাধ্য হয়ে শ্যালো মেশিন দিয়ে চাষাবাদ করছেন অধিকাংশ কৃষক।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর উদাসীনতার কারণেই মূলত মুখ থুবড়ে পড়ছে বেশিরভাগ সেচ প্রকল্প। সেচ খাতের এমন বেহাল দশার আরেকটি কারণ এই খাতে বরাদ্দ কমে যাওয়া। নতুন করে সেচ প্রকল্প গ্রহণ, পুনর্বাসন এবং খাল খনন কম হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকেও সেচ সেক্টরের এমন বেহালদশার চিত্র উঠে এসেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও দীর্ঘদিন ধরে সেচ খাতে খুব বেশি প্রকল্প দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় খাল খননও কম হচ্ছে। প্রতি বছর ১ হাজার ১১৯ কিলোমিটার সেচ খাল খননের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ৭০ কিলোমিটার সেচ খাল খনন হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে বলা হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অধিক সেচ প্রকল্প গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি চলমান বৃহৎ সেচ প্রকল্পগুলোতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ বাড়িয়ে পুনর্বাসন ও আধুনিকায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) পানি ব্যবস্থাপনা প্রধান মাহফুজ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, দেশের সেচ প্রকল্পগুলো অনেক আগের। ইতোমধ্যে অনেক পাম্পের জীবনকাল শেষ হয়ে গেছে। পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে অচল পাম্পগুলো মেরামত এবং নতুন স্থাপন করে সচল করার পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, সেচ প্রকল্পগুলোর বেহালদশার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমছে। পানির স্তর নিচে নেমে গেলে দেশ মরুকরণের দিকে চলে যাবে। এতে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন এবং খাবার পানির বড় সংকট দেখা দেবে। বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। যত দ্রুত সম্ভব ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সরে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।