মিশরে তিন দিনের নিবিড় আলোচনা শেষে ইসরায়েল ও হামাস একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সক্রিয় মধ্যস্থতায় হওয়া এই চুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য’। তবে, এ যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী বা কার্যকর হবে—সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, হামাস ২০ জন জীবিত এবং ২৮ জন মৃত জিম্মিকে ফেরত দেবে। ইসরায়েল মুক্তি দেবে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে এবং গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করবে। একই সঙ্গে প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করবে শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক, যার মাধ্যমে খাদ্য, ওষুধ, গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ করা হবে।
এ চুক্তির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি একদিকে যেমন ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন, অন্যদিকে হামাসকে হুঁশিয়ার করেছেন ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে। তার প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো—মিশর, কাতার ও তুরস্ককে আলোচনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত করেছে। ফলে প্রথমবারের মতো ইসরায়েল ও হামাস একটি কার্যকর কাঠামোর মধ্যে আসতে বাধ্য হয়েছে।
তবে এ যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশঙ্কা থেকেই যায়। কারণ, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এমন একটি চুক্তি হয়েছিল, যেটি মাত্র কয়েক সপ্তাহের মাথায় ইসরায়েলের আকস্মিক বিমান হামলায় ভেঙে পড়ে। ফলে হামাস এখন চায়, কোনো চুক্তি হোক ‘দৃঢ় নিশ্চয়তার ভিত্তিতে’। কারণ, জিম্মি ছেড়ে দিলে তারা দরকষাকষির শেষ শক্তিটুকুও হারাবে।
হামাসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমরা জানি ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির কথা বলে, পরে আবার যুদ্ধ শুরু করে। আমাদের হাতে জিম্মি না থাকলে তারা আগ্রাসন চালানো আরও সহজ ভাববে।’ ফলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চুক্তির বাস্তবায়ন তদারক করবে একটি বহুজাতিক শান্তিরক্ষা দল, যার নেতৃত্বে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। এতে মিশর, কাতার, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সেনারাও থাকতে পারে। তবে গাজার ভেতরে কোনো মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে না বলে জানানো হয়েছে।
এই চুক্তি কার্যকর হলেও রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আরও জটিল হবে। নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে ‘ইসরায়েলের কূটনৈতিক ও নৈতিক বিজয়’ বলে ঘোষণা করেছেন। তবে তার বিবৃতিতে কোথাও বলা হয়নি যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে যাচ্ছে। বরং তিনি যুদ্ধকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে অনেকেই মনে করেন। তার জোটের কট্টর ডানপন্থি অংশীদাররা এ চুক্তিতে অসন্তুষ্ট এবং কেউ কেউ পদত্যাগের হুমকি দিচ্ছেন। ফলে জোট সরকার টিকিয়ে রাখতেই হয়তো এই প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি মেনে নিচ্ছেন নেতানিয়াহু।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য এটি শুধু একটি মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতির বিষয় নয়—এটি তার ব্যক্তিগত প্রচারের অংশও। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার কয়েকদিন আগেই এই চুক্তি হওয়ায়, অনেকেই বলছেন তিনি ‘বিশ্বের শান্তিদূত’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চান। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, ‘এটি ইতিহাসে প্রথম একটি টেকসই ও চিরস্থায়ী শান্তির দিকে এগোনোর পদক্ষেপ।’ তবে বাস্তবতা বলছে, চুক্তির অনেক শর্ত এখনো অস্পষ্ট।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, গাজাকে কে শাসন করবে? চুক্তির পরবর্তী ধাপে একটি ‘ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট’ কমিটি গাজার শাসনভার গ্রহণ করবে। ট্রাম্প এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে একটি ‘শান্তি বোর্ড’ এই কমিটিকে তত্ত্বাবধান করবে। ভবিষ্যতে গাজার শাসনভার হস্তান্তর করা হবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে।
তবে এ পরিকল্পনায় হামাসের কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা থাকবে না—এমন ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে তা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, হামাস এখনো গাজায় একটি প্রভাবশালী শক্তি। তাদের সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা হয়তো নতুন সংঘর্ষের বীজ বুনবে।
এ ছাড়া রয়েছে নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে জটিলতা। হামাস স্পষ্ট জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা অস্ত্র ছাড়বে না। অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করেছে, গাজা থেকে ‘সব সন্ত্রাসী ও সামরিক অবকাঠামো’ ধ্বংস করা হবে। এই দুই বিপরীত অবস্থানের মধ্যে সমঝোতা আদৌ সম্ভব কি না, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তবু এই যুদ্ধবিরতির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, শিশুরা স্কুলহীন, মানুষ খাদ্য ও নিরাপত্তাহীন। এই মানবিক বিপর্যয় রোধে যুদ্ধবিরতি একটি আবশ্যক পদক্ষেপ। এর সফলতা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক চাপ, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
মন্তব্য করুন