শান্তনু মজুমদার
  ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০২:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শান্তনু মজুমদার

অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা গণতন্ত্রের পরিপন্থি

শান্তনু মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

শান্তনু মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিজইনফরমেশন তথা কু-তথ্য, গণতন্ত্র-ঘাটতি, রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ সম্পর্ক এবং নির্বাচনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। তার উচ্চশিক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং আগামী নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা : দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি আমাদের কী বার্তা প্রদান করছে?

শান্তনু মজুমদার : গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারি দল, মাঠের বিরোধী দল পালন করছে আলাদা আলাদা কর্মসূচি। এতে মানুষের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে। তবে সেটা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেছে বলে মনে করি না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের বিচারবুদ্ধি অনেক পরিপক্ব। নিজেদের ভালোমন্দ বোঝার সক্ষমতাও তাদের রয়েছে। তাদের বিচারবুদ্ধির ওপর আমার আস্থা রয়েছে। আমি এও মনে করি, জনমনে যতটুকু অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, সেটি দূর করার মতো সামর্থ্য আমাদের রাজনীতিবিদদের রয়েছে।

কালবেলা : জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ কী?

শান্তনু মজুমদার : প্রতিবারই নতুন মনে হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর প্রধান কারণ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার ঘাটতি। আত্মপরিচয়, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং জাতীয়তাবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। সবসময় তার প্রকাশ উগ্রভাবে না ঘটলেও ভেতরে ভেতরে এটা চলমান থাকে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীভাবে গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক সংস্কারও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে সরকারি দল ও বিরোধী দল অনেক ক্ষেত্রেই কম্প্রোমাইজড আচরণ করে। তাদের সমর্থনে নিজ নিজ বয়ান তৈরি করে। অধিকার রক্ষা এবং দায়িত্বশীলতার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সীমাবদ্ধতাগুলো অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না।

১৯৯৬ সালে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে নির্বাচনকালীন ক্ষমতা হস্তান্তর করার যে বিধান চালু হয়েছিল, সেটা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রাকে নিদারুণভাবে বিঘ্নিত করেছে। গণতন্ত্র কোনোভাবেই অনির্বাচিত মানুষের হাতে এক মিনিটের জন্য ক্ষমতায় যাওয়াটা বৈধতা দেয় না। তা সে অবৈধ ক্ষমতা দখল হোক আর বহুলালোচিত ‘নিরপেক্ষ’ লোকদের শাসন হোক। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ, এটিও আমি মনে করি না। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আস্থার ঘাটতি কমানো এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করানোই হচ্ছে আসল কথা। ভালো নির্বাচনের জন্য সুপারম্যান হওয়ার দরকার নেই। দরকার স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারার সক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।

কালবেলা : মাঝে দুই বছর ছাড়া ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলমান। এ লম্বা সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেনি কেন?

শান্তনু মজুমদার : এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। আজ যেসব দেশ পরিণত গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত, তাদেরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডে একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের অবসান, পরবর্তীকালে আমেরিকার স্বাধীনতা বা ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে প্রো-গণতান্ত্রিক বিশ্বের পথচলার দিকে তাকালে বোঝা যাবে যে, গণতন্ত্র চর্চা বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো চটজলদি পথ নেই। অবৈধ ক্ষমতা দখল, একাধিকবার সংবিধানের অসাংবিধানিক সংশোধনী, দলগুলোর মধ্যে অতি-গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে ব্যাপক পার্থক্য, পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি এবং সংবিধানবর্ণিত দায়িত্বশীলতা প্রদর্শনে দলগুলোর দুর্বলতার মতো বিষয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনায় সামনের দিকে আসতে পারে। এ ছাড়া সুশীল সমাজের একটি অংশের মধ্যে নানা যুক্তিতে অনির্বাচিত মানুষের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদানের পক্ষে যুক্তি দেওয়াটাও ক্ষতির কারণ হয়েছে।

কালবেলা : বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন কি সম্ভব?

শান্তনু মজুমদার : আমরা গণতন্ত্র চাই। আর গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এর জন্য গণতন্ত্র স্বীকৃত পন্থায় গত দুইশ বছরে সারা দুনিয়া যা যা করছে, আমাদেরও সে পথে হাঁটতে হবে। সরকারি দল যাতে নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে না পারে, বিরোধীরা যাতে অধিকার আদায়ের দাবিতে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র তথা নির্বাচিত লোকদের দ্বারা শাসনের ধারণা থেকে সরে না যায়, সুশীল সমাজ যাতে মাথাব্যথার জন্য মাথাকাটার পরামর্শ না দেয়—এসব বিষয় নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

কালবেলা : নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি। এ সময়ের মধ্যে কী করা যেতে পারে?

শান্তনু মজুমদার : নির্বাচন কমিশনের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা জরুরি। পুলিশ, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে পক্ষপাতহীন রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ডিসি, এসপি ও ইউএনওদের দৈবচয়ন ভিত্তিতে বাছাই করে পোস্টিং দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন ও বিরোধীপক্ষকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কাজ সংবিধান অনুযায়ী বিরোধীদের প্রাপ্য অধিকারগুলো সংরক্ষণ করা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলে তার প্রভাব নির্বাচনে পড়বে। ক্ষমতাসীনদের কু-তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। বিরোধীদেরও কতগুলো দায়িত্ব রয়েছে। মতপ্রকাশ, সমবেত হওয়া, প্রতিবাদ জানানো বিরোধীদের অধিকার। সরকারের কঠোর থেকে কঠোরতর সমালোচনা বিরোধীপক্ষের এখতিয়ারে পড়ে। কিন্তু সরকার হঠানোর জন্য কু-তথ্যের আশ্রয় নেওয়া কিংবা সংবিধান নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া ভালো ফল বয়ে আনবে না।

কালবেলা : নির্বাচন কেন্দ্র করে বিদেশি রাষ্ট্রের চাপ এবং সরকারের অবস্থান কীভাবে বিশ্লেষণ করছেন?

শান্তনু মজুমদার : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এমন মনমানসিকতা নিয়ে আসে যে, এখানে একটা ঝামেলা হয়েছে এবং তারা নিজেরা সুরাহা করতে পারছে না; আমরা মাঝখানে থাকি এবং সমাধানের চেষ্টা করি, তাহলে ঠিক আছে। আজকের এই ইন্টারকানেকটেড দুনিয়ায় এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্ত হোক। ভালোভাবেই যুক্ত হোক। আমাদের ভালো একটা নির্বাচন পাওয়া দিয়ে কথা।

কালবেলা : যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান কর্তৃক দেশটির সরকার, এমনকি জাতিসংঘে থাকা তাদের প্রতিনিধিকে চিঠি প্রদান আমাদের জন্য কী বার্তা প্রদান করে?

শান্তনু মজুমদার : বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বসংস্থা হিসেবে জাতিসংঘ কথা বললে তার অর্থ একরকম। আবার কোনো একটি দেশ বা একাধিক দেশের জোট কথা বললে তা আরেকরকম। সবাই হয়তো একই কথা বলছেন। তথাপি জাতিসংঘ এবং রাষ্ট্র বা জোটকে আলাদা করে দেখাটা শ্রেয়। সবকিছুকে উড়িয়ে দিলে চলবে না। কিছু ক্ষেত্রে মান্যমানতা থাকা আবশ্যক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। আবার বিরোধী দল যদি মনে করে বিদেশিরা তাদের নির্বাচনে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য বসে আছেন, সেটিও ভুল। সর্বোপরি আমরা আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে পরিমিতিবোধসম্পন্ন ভাষা প্রত্যাশা করি।

কালবেলা : বাংলাদেশের সরকার এবং বিরোধী দল কখনো সামনাসামনি বসতে চায় না। অনেকে এখানে বিদেশি মধ্যস্থতার কথা বলছেন। আপনি একে কতটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন?

শান্তনু মজুমদার : আমি দেশি সমস্যার দেশি মধ্যস্থতাকারী ও দেশি সমাধানের পক্ষে। কিন্তু চাওয়ামাফিক সবকিছু হয় না। একটা সময় আমরা রাজনীতির নাজুক পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করতাম। এখন অবশ্য সুশীল সমাজের কীর্তিমানদের গুরুত্ব বেশি। বিদেশিরাও তাদেরই খোঁজেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজের ভূমিকা রাখাটা প্রয়োজনীয়। দেশি-বিদেশি যাই হোক না কেন, এমন কোনো আম্পায়ার চাই না যিনি গণতন্ত্রের বেসিকে কম্প্রোমাইজ করেন। বাংলাদেশকে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বাজে ও জটিল রাজনীতিকদের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ মোটেও কোনো স্পেশাল কেস নয়। বাংলাদেশ আর দশটা উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মতো একটা রাষ্ট্র। এ ধরনের রাষ্ট্রে রাজনীতিতে যে ধরনের ঝুট-ঝামেলা দেখা যায়, বাংলাদেশেও তা কমবেশি দেখা যায়। তবে যে সমস্যা রয়েছে, তা উত্তরণযোগ্য।

কালবেলা : বিদ্যমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আমরা কীভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারি?

শান্তনু মজুমদার : সরকার এবং বিরোধী দুপক্ষেরই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। সংযমী হতে হবে। তারা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করতে পারেন, পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দিতে পারেন। কিন্তু সংঘর্ষ বা সহিংসতায় লিপ্ত হতে পারেন না। পুলিশ প্রশাসন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনের বাইরে যাওয়া যাবে না। মানুষের জীবন ও পণ্যের ক্ষতি বা জনজীবনের দুর্ভোগ হয় এমন কোনো কিছু বিরোধী দলের করা ঠিক হবে না। সরকারকেও বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় সহায়তা জোগাতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিতর্কিত জলসীমায় চীন-ফিলিপাইনের জাহাজের সংঘর্ষ

চট্টগ্রামে মেয়রের গাড়ির ধাক্কায় ২ পুলিশ সদস্য আহত

যেভাবে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’-এর পলাশের কাছে পৌঁছলেন সেই ভক্ত

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল বুটেক্স শিক্ষার্থীর

বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন করলে ভোট বাতিল : ইসি

এসএসসি পরীক্ষার সম্ভাব্য সময় জানা গেল

ইসরায়েল নামক দুষ্ট ছেলে ‘আমেরিকার সন্তান’ : ওবায়দুল কাদের

ফুটবলে বিকেএসপি নিষিদ্ধ

হুমকির ‍মুখে জীববৈচিত্র্য / জাতীয় উদ্যানে কভারবিহীন বৈদ্যুতিক তার, বন্যপ্রাণীর মরণ ফাঁদ!

ডেঙ্গুতে ৯ মৃত্যু

১০

হাউজিংয়ের খেলার মাঠ প্লট আকারে বিক্রি করা যাবে না : মেয়র আতিক

১১

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ডিআরইউ নেতৃবৃন্দের শ্রদ্ধা

১২

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদই ইসরায়েলের লক্ষ্য : জর্ডান

১৩

ঝুঁকিপূর্ণ পিচ, পরিত্যক্ত বিগ ব্যাশের ম্যাচ

১৪

জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সময় জানাল ইসি

১৫

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এসএসসি পরীক্ষার রুটিনটি ভুয়া

১৬

৪৬তম বিসিএসের আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু

১৭

বালু তুলতে গিয়ে প্রাণ গেল শ্রমিকের

১৮

পর্যটকসহ ডুবোচরে আটকে গেল সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ

১৯

আলিয়া আমার প্রথম স্ত্রী নয়, আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে দেখিনি : রণবীর

২০
X