বেদনাদায়ক হলেও এ কথা সত্য যে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের লাল রং বছর না পেরোতেই ফিকে হয়ে গেছে। পেছনে ফিরে দেখলে গত এক বছরকে আশাভঙ্গের বছর হিসেবে মনে হয়। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ এবং রাজপথে নিরন্তর আন্দোলনে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এরই মধ্যে বিভেদ অনেকদূর গড়িয়েছে। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান যেমন বিপরীতমুখী, তেমনি সাম্প্রতিককালে তাদের বক্তব্য-বিবৃতির ভাষা শুধু আক্রমণাত্মক নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কুৎসিত রূপ ধারণ করেছে। সেই জুলাইকে এবারের জুলাইয়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটাতে বিএনপিসহ গণতন্ত্রকামী অপরাপর রাজনৈতিক দল গত ১৫ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল। কোটা সংস্কার থেকে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতৃত্ব একপর্যায়ে চূড়ান্ত কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো সর্বাত্মকভাবে এ কর্মসূচি সফল করতে এগিয়ে আসে। কোটা সংস্কার আন্দোলন শেখ হাসিনার পতনের এক দফা কর্মসূচিতে পরিণত হয়। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী, হাজার হাজার নারী, শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক, দোকানদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী স্বৈরাচারী সরকারের পতনে একট্টা হয়ে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। জনরোষ বিস্ফোরিত হয়। গণঅভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের সফল পরিণতি ঘটে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে।
সফল গণঅভ্যুত্থান যে অমিত সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল, বছর না ঘুরতেই তা যেন আজ মরুপথে দিশা হারিয়ে ফেলেছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি যেভাবে সংহত করা দরকার ছিল—অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক শক্তি তা করতে পারেনি। ফলে দেশজুড়ে এক ধরনের নৈরাজ্য অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। মব সন্ত্রাস, নারীর অবমাননা, ব্যাপকভাবে মাজার ভাঙা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধাদান অথবা পণ্ড করে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কলেজের অধ্যক্ষ স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অপদস্থ করা অথবা অনেক ক্ষেত্রে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। চাঁদাবাজি, টার্মিনাল দখল এখন পুরোনো খবরে পরিণত হয়েছে। থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া এবং পুলিশের ওপর আক্রমণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। জনজীবনে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদে ফিরতে পারবেন কি না, এ শঙ্কাও অনেকের মধ্যে কাজ করছে। সরকার আইনশৃঙ্খলায় কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। অর্থনীতিতে বিরাজ করছে এক ধরনের স্থবিরতা। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। ট্রাম্পের শুল্ক-ঝড় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশের রপ্তানি খাতির জন্য অস্বস্তি ডেকে এনেছে। নতুন শুল্ক কাঠামো কার্যকর হওয়ার আগেই বেশ কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি আদেশ স্থগিত করেছে। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের বৈঠক থেকে ইতিবাচক কোনো ঘোষণা না আসায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়ে গেছে। প্রশাসনও পুরোপুরি সুস্থির নয়। মাঝেমধ্যেই অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধর্মঘট অনেক আগে প্রত্যাহার হলেও এখনো বিরাজ করছে চাকরি হারানোর আতঙ্ক।
চব্বিশের জুলাইয়ের স্মরণে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। তবে এসব কর্মসূচিতে যেন প্রাণের স্পন্দন নেই। বছর না ঘুরতেই কেন এমন পরিস্থিতি হলো? শহীদ আবু সাঈদের মায়ের কণ্ঠে শোনা যায় আক্ষেপের সুর। গত বছর ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলির সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ। পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু মুহূর্তের মধ্যেই আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। সারা দেশে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন পরিণত হয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। শহীদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘দেশে শান্তি আসেনি। সব আগের মতোই রয়েছে। কারণে-অকারণে মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে। আমার মতো এখনো অনেক মায়ের বুক খালি হচ্ছে।’ মনোয়ারা বেগমের প্রশ্ন, ‘আবু সাঈদের জীবন দিয়ে কী হলো? ছেলেটা হামার থাকাই ভালো আছিল। দেশ তো গঠন হলো না। আগে যেমন ছিল ঠিক সেরকমই আছে (সমকাল ১৬ জুলাই)।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির মুখ ও সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছেন, ‘জুলাই থেকে জুলাইয়ে আসতেই রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতা নাই হয়ে গেছে। নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডার বিভক্ত না হয়ে মিনিমাম জায়গায় ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করলে গোপালগঞ্জে যাওয়ার জন্য পুলিশ প্রটেকশনের প্রয়োজন হতো না।’ গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি ১৬ জুলাই এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছিলেন। বিবৃতিতে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাবকে গোপালগঞ্জ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে উমামা ফাতেমা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের অপদস্থ হতে দেখাটা আমাদের জন্যই কষ্টের।’
নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মতভিন্নতা অনেক দিন ধরে শুধু প্রকট হয়নি, রাজনৈতিক বিরোধিতা তীক্ষ্ণতায় পর্যবসিত হয়েছে। জামায়াত ও এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার ইস্যুতে বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে তাদের অবস্থান বিপরীতমুখী। এই তিন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির বিরোধ দিন দিন বাড়ছে। বিএনপি শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনের আগে সংস্কার ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করার দাবি জারি রেখেছে। বিশেষ করে এনসিপি নেতারা বলেছেন, বিচার ও সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। তাদের কেউ কেউ ‘বিচার ছাড়া নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’ এমন কথাও বলেছেন।
এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে পুরান ঢাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগকে অবর্ণনীয় নৃশংসতায় হত্যার ঘটনা রাজনীতিতে প্রবল উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। যে নির্মমতায় সোহাগকে হত্যা করা হয়েছে, তা দেখে সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। সোহাগ ও তার হত্যাকারীদের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা প্রধান দলটিকে লক্ষ্য করে তীর ছোড়ার সুযোগ করে দেয়। যদিও বিএনপি যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের পাঁচজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘অপরাধী যেই হোক, তার স্থান কখনো আইন ও ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে পতিত আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এই নির্মম ঘটনা দেশের মানুষের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।’ সোহাগ হত্যাকাণ্ডের দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে দল এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে টার্গেটে পরিণত করা হয়। কুৎসিত ভাষায় তারেক রহমানকে আক্রমণ করা হয়। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধে এমন নোংরা ভাষায় আক্রমণের ঘটনা অনেকেই হতবাক করে দেয়। এ ধরনের কদর্য ভাষায় কাউকে আক্রমণ করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন ওঠে। চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এনসিপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধেও। এনসিপি পথযাত্রা কর্মসূচির পথসভায় বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজ ও মুজিববাদের নতুন পাহারাদার’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। গত ১৪ জুলাই পটুয়াখালী সার্কিট হাউস সড়কে এক সমাবেশে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘মুজিববাদী সংবিধান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগোতে দেয়নি। কিন্তু সেই মুজিববাদী সংবিধান এখন টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছে বিএনপি। বিএনপি এখন চাঁদাবাজ দলে পরিণত হয়েছে। মুজিববাদের নতুন পাহারাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ পাহারাদারকে আপনাদের প্রতিহত করতে হবে।’
জুলাই অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ হওয়া তরুণ নেতারা এবং দলগুলো এখন ভিন্ন ভিন্ন পথে হাঁটছে। ঐক্যের মধ্যে অনেক আগেই বিভেদের সুর স্পষ্ট শোনা গেছে। ঐক্যের মূলধারা থেকে রাজনৈতিক শক্তি দূরে সরে গেছে। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর পাল্টাপাল্টি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের নেতারা এখনো গ্রহণ করতে পারেননি। বর্তমানে রাজনীতির নামে যা চলছে, তা যেন এক অশনিসংকেত। অবস্থা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, অভ্যুত্থানের চেতনা জুলাই থেকে এ জুলাইয়ে এসে হারিয়ে যেতে বসেছে। রাজনীতিতে সহনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে। একপক্ষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। সুস্থ রাজনীতির চর্চা নয়, প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করাই যেন লক্ষ্য।
গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক শক্তিগুলো যখন লড়াইয়ে লিপ্ত তখন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেকটাই নির্লিপ্ত মনে হয়। রাজনীতির সংকট যেভাবে বেড়েছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে, প্রফেসর ইউনূস কি চোরাবালিতে পা ঠেকিয়েছেন? প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব আদর্শ ও কর্মসূচি থাকে। এটা থাকাটাই স্বাভাবিক। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য থাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া। কোনো কোনো ছোট দল বড় দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে অথবা জোট গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না, তারা চায় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে। তবে চব্বিশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল, পথ ও মত ভিন্ন হলেও রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলো ন্যূনতম কিছু বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। যাতে দেশের জনগণ শান্তি ও স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে। তবে এ আকাঙ্ক্ষা অনেক আগেই তিরোহিত হয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে ঐক্যের বদলে শুধু ভাঙনের শব্দ শোনা যায়।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন