কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

যাদের ভাগ্য বদলায় না!

মো. কামরুল হাসান
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

একটি রাষ্ট্রের চারটি উপাদান অপরিহার্য। ভূমি, জনগণ, সার্বভৌমত্ব আর সরকার। প্রত্যেকটি উপাদানের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক বিদ্যমান। ভূমি বলতে স্বাধীন ভৌগোলিক সীমানা, সার্বভৌমত্ব বলতে একটি রাষ্ট্রের শক্তিশালী মেরুদণ্ড ও কূটনৈতিক সক্ষমতাকে বোঝায়। যেটি বহিঃশক্তির মুরুব্বিয়ানা বা সাম্রাজ্যবাদী আচরণ থেকে মুক্ত হওয়াকে নির্দেশ করে। যদিও বিশ্বের পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর কাছে দুর্বল রাষ্ট্রের আনুগত্য ও নির্ভরশীলতা থাকে নানা বাস্তবতার কারণে।

আরেকটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে, সরকার আর সরকারের ম্যান্ডেট হচ্ছে ‘জনগণ’। সরকার ও জনগণ দুটি একই—মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, পারস্পরিক সংযোগ-সম্বন্ধ প্রবল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোতে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে রাজনৈতিক দল। বিশেষ পরিস্থিতিতেও কখনো সরকার গঠিত হয়, সেখানে জনগণের সমর্থন ব্যালটে নয়, বিপ্লব হয়ে যায় সেই সরকারে ম্যান্ডেট।

সরকার রাষ্ট্রের চালকের আসনে থাকে। রাষ্ট্র বিনির্মাণ, আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি নাগরিক জীবনমানের উন্নতিসাধন, মৌলিক এবং নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতি গঠিত বিশেষ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা থাকে বেশি। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে জুলাই বিপ্লব হয়েছে, অথচ জনগণের সেই প্রবল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বাস্তবতা পুরোদস্তুর ভিন্ন। সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কে যোজন-যোজন দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়, যদিও জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। কাগজে-কলমে স্বতঃসিদ্ধ এ বাক্যটার সঙ্গে বাস্তবচিত্রের প্রভেদ আকাশ-পাতাল!

জনগণ তিন ধরনের হতে পারে। প্রথমত, বুর্জোয়া শ্রেণি—যারা অসাধারণ জনগণ, রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—ধনী ব্যবসায়ী, সরকারি অফিসার, শক্তিশালী মিডিয়া ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সেলিব্রেটি মহল। দ্বিতীয়ত, নিম্ন আয়ের চাষাভুষা-মুটে-মজুর শ্রমজীবী মানুষ। তারাই কার্যত এ দেশের সাধারণ জনগণ বলে বিবেচিত। তৃতীয়ত, সেই জনগোষ্ঠী যারা ছিন্নমূল, সুবিধাবঞ্চিত, মৌলিক নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা প্রাপ্তি যাদের কাছে বিলাসিতা। যারা সাধারণ জনগণ ধারণার মধ্যেও বিবেচিত হন না।

মাথায় ছাউনি নেই, দুবেলা খাবার জোটে না। রাস্তার ধারে, রেললাইনের ধারে কিংবা ওভারব্রিজের নিচে যারা ঘুমায়। সরকার আসে-সরকার যায়, যাদের ভাগ্য বদলায় না। বায়ান্নর ভাষা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, চব্বিশের জুলাইয়ের বিপ্লব-পরবর্তীও এই জনগণ শ্রেণির অবহেলিত অংশটার কথা কেউ সত্যিকার অর্থে বলেন না। যাদের টেকসই পুনর্বাসনে কোনো সংস্কার কমিশন কিংবা কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি কস্মিনকালেও!

শিশু, নারী, বৃদ্ধ, মধ্যবয়স্ক মানুজনও আছে এই শ্রেণিতে। রাস্তায় যেসব শিশু বাসবাস করে, সেই শিশুসত্তার পাশেই জুড়ে দিতে হয় ‘পথ’ শব্দটা। পথশিশু হিসেবে সম্বোধন করলেই আমাদের মস্তিষ্কে যাদের চেহারা, গঠন, অবয়ব ভেসে ওঠে তারা। শ্লেষের ভঙ্গিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত সিস্টেমের কাছে যারা ‘টোকাই’ হিসেবেও বেশ পরিচিত। এই পথশিশুদের মধ্যে বেশিরভাগের অদৃষ্টের নির্মম গল্প আছে।

পরিসংখ্যান বলছে, এদের অধিকাংশই অল্প বয়সে পিতা-মাতার বিবাহবিচ্ছেদের ফলে নিগৃহীত হয়েছে, কারও পিতা-মাতা মারা গেছে, কারও ক্ষেত্রে পিতা-মাতাহীন, জানেই না সে কার সন্তান! পৃথিবীতে আসার ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের কোনো হাত নেই, তবুও কোনো শিশু হয় ‘পথশিশু’ আর ‘টোকাই’! নিয়তির কাছে তাদের শিশুমন হেরে যায়, মুখ থুবড়ে পড়ে স্বপ্ন, আশা আর স্নেহ। মূলধারার স্বাভাবিক জীবন থেকে তারা অনেক দূরে, একটা আলাদা, বিচ্ছিন্ন, স্বয়ম্ভু জগৎ হয় তাদের! এভাবেই চলে তাদের জীবনচক্র। সময়ের পরিক্রমে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়, সংসারও পাতে রাস্তার ধারেই। এরপর বৃদ্ধও হয়—প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলছে এমন। ব্যতিক্রম উদাহরণও আছে।

এদের ব্যাপারে সমাজের ধারণা পরিষ্কার—টোকাইরা হিংস্র, এরা গুল খায়, মদ খায়, গঞ্জিকা সেবন করে, গাম খায়, চুরি-ছিনতাই করে। কিন্তু এসবের নেপথ্যে কী সেই কারণ, কেন এই অপরাধ প্রবণতা বন্ধ হয় না—এসব নিয়ে চিন্তার ঢেকুর খুব কম, নিবন্ধ রচনাও ফের কম। তাদের টেকসই পুনর্বাসনের দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায় না কখনো। কখনো রিহ্যাবিলিটেশন সংস্থা আর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে দেখা যায় কয়েকবেলা আহার, ঈদের সময় ঈদ উপহার বিতরণে বা শীতের সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করছে! সংবাদের শিরোনাম হয় ‘ছিন্নমূল পথশিশুদের শীতবস্ত্র, ঈদসামগ্রী বিতরণ’। সমাজ, সিস্টেম, গণমাধ্যম, শিক্ষিত সমাজই ‘পথশিশু’ শব্দটা জিইয়ে রাখে! রাস্তার ধারে বড় হওয়া নাগরিকজীবন একটি রাষ্ট্রের জন্য গৌরবের কিছু নয়। বরং লজ্জার। তাদের পুনর্বাসনে, একটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে কার্যকর উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন দরকার।

রাষ্ট্রের অবশ্যই দায়বদ্ধতা আছে। বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের দায়বদ্ধতা আছে। কবি-লেখকের দায়বদ্ধতা আছে। আছে চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী, সুধীজনের দায়বদ্ধতা। সবাই মিলে নতুন, আধুনিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর টেকসই সমাধান করতে চাইলে অসম্ভব না, তবে কঠিন। এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেটা হবে শূন্য পথশিশুর বাংলাদেশ, শূন্য উদ্বাস্তুর বাংলাদেশ।

মো. কামরুল হাসান, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মুরাদনগরে বিষাক্ত স্পিরিট পানে ২ জনের মৃত্যু

প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, থানায় মামলা

কুষ্টিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ভোমরারা হতাশ হয়েছেন : নুর

দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা

এবার চট্টগ্রামে সাংবাদিককে গলা টিপে হত্যাচেষ্টা

সাবেক ৩ গভর্নর ও ৬ ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব

এনসিপির হয়ে নির্বাচন করব কিনা সিদ্ধান্ত নেইনি : আসিফ মাহমুদ

সবাইকে টেস্ট খেলানো জরুরি নয় : জোরাজুরিতে দেউলিয়ার শঙ্কা

প্রবাসেও আপ বাংলাদেশের কমিটি ঘোষণা 

১০

ইসরায়েল পুড়ছে রেকর্ড তাপমাত্রায়

১১

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে আর্থিক সহায়তার চেক দিল যমুনা অয়েল

১২

অসহায় পরিবারের দুই শিশুকে চিকিৎসা সহায়তা-অটোরিকশা দিলেন তারেক রহমান

১৩

৩০০ আসনে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে গণতন্ত্র মঞ্চ 

১৪

ড্রোন শো পরিচালনার প্রশিক্ষণে চীন যাচ্ছেন ১১ জন

১৫

সামাজিক কাজে অবদান রাখায় নিবন্ধন পেল প্রভাত

১৬

স্বাস্থ্যের ডিজির আশ্বাসে মন গলেনি, নতুন কর্মসূচি ছাত্র-জনতার

১৭

শহীদ মিনারে কাফনের কাপড় পরে বস্তিবাসীদের অবস্থান

১৮

পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে : চরমোনাইর পীর

১৯

চট্টগ্রামে ১০ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা মেয়রের

২০
X