মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
তোফায়েল আহমেদ
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৪ এএম
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৪, ১১:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তোফায়েল আহমেদের নিবন্ধ

পঁচিশে মার্চের স্মৃতি

পঁচিশে মার্চের স্মৃতি

’৭১-এর পঁচিশে মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। মনে পড়ে, বাইশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল এমএজি ওসমানী সাহেব (মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিঙ্ক দ্যাট টুমোরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিঙ্ক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ।’ তখন ওসমানী সাহেব পুনরায় তীক্ষ্ণ স্বরে তার কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘কাল তো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কি কিছু করতে চাইবে না?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কিছু করতে পারে। তার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না।’ কী নিখুঁত হিসাব বঙ্গবন্ধুর। হিসাব করেই তিনি বলেছিলেন পঁচিশে মার্চেই পাকিস্তানিরা ক্র্যাকডাউন করবে।

পঁচিশে মার্চ বহু লোক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসেছেন। অনেকেই অনুরোধ করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু, ৩২ নম্বরের বাসভবন ত্যাগ করেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ওরা যদি আমাকে না পায়, ঢাকা শহরকে ওরা তছনছ করবে। লক্ষ লক্ষ লোককে ওরা হত্যা করবে। আমি তো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমি এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারি না। আমি আমার বাড়িতেই থাকব। কারণ, আমি আমার জীবন বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। জীবন এবং মৃত্যু একসাথে। আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মৃত্যুকে বারবার আলিঙ্গন জানিয়েছি। এবারও আমি এখানেই থাকব। আমার দেশ যে স্বাধীন হবে এতে কোনো সন্দেহ নাই।’ বঙ্গবন্ধু সবাইকে শুভকামনা করে বিদায় জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা যাও, আমার যা করার আমি করেছি।’ আমার মনে আছে, ২৫ তারিখ তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যিই আমার জীবন সার্থক। আমি যা চেয়েছিলাম আজ তাই হতে চলেছে। এই তো প্রথম বাঙালিরা বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পেরেছে। আজ আমার কথামতো, আমার নির্দেশিত পথে বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে। আজ আমি যা বলি মানুষ তা পালন করে। আমার অসহযোগ আন্দোলন সার্থক ও সফল হয়েছে।’

আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, ওরা তো আপনাকে গ্রেপ্তার করবে। আপনাকে হত্যাও করতে পারে। উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমাকে গ্রেপ্তার করে, হত্যা করে ওদের লাভ হবে না। ওরা আগেও আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। ওদের লাভ হয় নাই। এবারও আমাকে গ্রেপ্তার করুক, হত্যা করুক ওদের লাভ হবে না। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। আমার মৃত্যুর পরে কেউ যদি আমার মৃতদেহ দেখে, দেখবে আমার মুখে হাসি। আমার জীবন সার্থক। কারণ, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হতে চলেছে।’ আমি এবং মনি ভাই সবশেষে রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের দুজনের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। কোথায় গেলে অর্থ ও সাহায্য পাব সেসব কথা বলে আমাদের কপালে চুমু দিয়ে সে রাতে বিদায় দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। সেগুনবাগিচার একটি প্রেসে মনি ভাই লিফলেট ছাপতে দিয়েছিলেন। সেগুনবাগিচা গেলাম। আমরা হেঁটে মনি ভাইয়ের বাসায় গেলাম। এরপর রাত ১২টায় জিরো আওয়ারে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী শুরু হয় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকা নগরীর নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের ভয়াল গর্জনে রাত ১২টার পর পুরো নগরীই জাহান্নামে পরিণত হয়। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শুরু করে ইতিহাসের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। শুরু হয় বাঙালি নিধনে গণহত্যা। চারদিকে শুধু বিকট আওয়াজ। লক্ষাধিক লোককে এক রাতেই হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। রাতে ওখানেই ছিলাম আমরা।

২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ‘মুজিব ইজ এ ট্রেইটর। দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিশড।’ বক্তৃতায় তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে আরও আগেই আমার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত ছিল। এদের নেতাদের আগেই আমার গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল।’

পরদিন ২৭ মার্চে দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার হলে আমরা ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দিন গগনের (যিনি পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন) বাড়িতে আশ্রয় নিই। কেরানীগঞ্জে দুই রাত থাকার পর ২৯ মার্চ আমি, মনি ভাই, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব এবং আমাদের বন্ধু ’৭০-এ নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আবু হেনাসহ যিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় যে পথে কলকাতা গিয়েছিলেন এবং এসেছিলেন, সেই পথে আমরা প্রথমে দোহার-নবাবগঞ্জ, পরে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়া হয়ে বালুরঘাট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে ৪ এপ্রিল আশ্রয় গ্রহণ করি।

মার্চের ২৫ থেকে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত কালপর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে ৯ মাসব্যাপী বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নীলনকশায় ঢাকার চারটি স্থান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল—বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং তৎকালীন পিলখানা ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাসহ ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগ নেতা চিশতী হেলালুর রহমান ও জাফর আহমদকে হত্যা করে। এ ছাড়া জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ঢাকার চারটি স্থান ছাড়াও রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর আওতাভুক্ত এলাকা। ’৭১-এর গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ যে শহীদ হয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ বহন করছে তৎকালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো। অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা হেরাল্ড ট্রিবিউনের রিপোর্ট অনুসারে পঁচিশে মার্চ রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ১ লাখ লোককে হত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থীশিবিরগুলো পরিদর্শন করেন ’৭১ সালে। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালাবার অভিযোগ করেন। ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে গণহত্যা তদন্তে পাকিস্তানে যে ‘হামিদুর রহমান কমিশন’ গঠিত হয়েছিল, সেই কমিশন তাদের রিপোর্ট বাংলাদেশে গণহত্যার কথা স্বীকার করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কথা বলেছে।

পৃথিবীতে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এভাবে রক্ত দিয়ে একজন নেতার নেতৃত্বে পুরো বাঙালি জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে ৯ মাসে মহান বিজয় অর্জন মানবজাতির ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনাই বটে!

লেখক: সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

ইমেইল: [email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফোর্বসের তালিকায় স্থান পাওয়া ৯ তরুণকে ছাত্রলীগের শুভেচ্ছা

মোবাইল কিনে না দেওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে বসে লাখ টাকার অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবসা

র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু, ক্যাম্প কমান্ডারসহ প্রত্যাহার ৪

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৮২ শতাংশ : বিবিএস

ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল শিশুর

জাল স্বাক্ষরে ওষুধ বিতরণের অভিযোগ

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরবদের মুনাফেকি ও সুপার হিরোদের অবদান

নোয়াখালীতে ৩০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ

নিপুণের পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে : ডিপজল

১০

ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে চবিতে সাইক্লিস্টের র‍্যালি

১১

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আইআইইউসি প্রতিনিধিদলের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১২

আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ

১৩

রাইসির মরদেহ কোথায়, জানাজার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত?

১৪

রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ৫০ বছরের পুরোনো

১৫

মসজিদে ঢুকে ইমামকে যুবদল নেতার বেধড়ক মারধর

১৬

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের পরও বেঁচে ছিলেন এক আরোহী

১৭

ছেলের আত্মহত্যায় মায়ের বিষপান

১৮

অপু বিশ্বাসের অভিযোগে ৩ জনকে সতর্ক করল পুলিশ

১৯

চট্টগ্রামে সোর্সের তথ্যে বেপরোয়া পুলিশ!

২০
X