মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৩৮ এএম
আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুই রাষ্ট্রনায়কের উপলব্ধি!

দুই রাষ্ট্রনায়কের উপলব্ধি!

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ সম্প্রতি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ঘণ্টার একটি ভাষণ দিয়েছেন। প্রায় ১৭ হাজার শব্দের ওই ভাষণ ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আলোচনার আগে ব্যক্তি মাখোঁ সম্পর্কে একটু বলা প্রয়োজন। ছোটবেলা থেকেই তিনি এক ব্যতিক্রম মানুষ। নিজের সমবয়সীদের সঙ্গে তার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি সমানভাবে যেত না বলে সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতেন না। জীবনসঙ্গী বাছাইয়েও তিনি ব্যতিক্রম। নিজের থেকে ২৪ বছর বড় তারই ড্রামা শিক্ষিকা ব্রিজিতকে বিয়ে করতে জেদ ধরেন এবং শেষাবধি তার জেদের কাছে হার মেনে তিন সন্তান, স্বামীকে ছেড়ে ব্রিজিত মাখোঁর হাত ধরেন (তার সমালোচকরা কেউ কেউ তাকে জেরন্টোফাইল বলে থাকেন। এটি একটি মানসিক অবস্থা। এ অবস্থার মানুষ প্রণয়ের ব্যাপারে নিজের চেয়ে অনেক বড় অথবা বয়স্ক মানুষকে পছন্দ করে থাকে। এটা অবশ্যই তার ব্যক্তিগত বিষয়)। মাখোঁ ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বইয়ের সঙ্গে থাকেন, সময় পেলেই পড়েন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে একাধিকবার বলেছেন, তার বামপন্থি নানা তার আদর্শ, যিনি তাকে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ২০১২ সালে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাদের দপ্তরে ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পান, তখন ছিলেন দাপ্তরিক কাজে একেবারে আনাড়ি। কিন্তু অচিরেই তার দক্ষতা সবার নজর কাড়ে। সে কারণে ফরাসি সাংবাদিকরা তাকে মোজার্ট অব এলিসি (এলিসি হলো ফরাসি প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন) নামে অভিহিত করেন।

বর্তমান বিশ্ব নিয়ে মাখোঁর উপলব্ধি এবং উদ্বেগ ইউরোপের তো বটেই, ইউরোপের বাইরের মানুষের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। তিনি যা বলেছেন তা এরকম—‘আমরা ইউরোপীয়রা তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। বিশ্বের দুই পরাশক্তি (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মকানুন মানছে না। ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি পার ক্যাপিটা বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আর ইউরোপের মাত্র ৩০ শতাংশ। এ হিসাব যুক্তরাষ্ট্রের ইনফ্লাশন রিডাকশন অ্যাক্ট তৈরির আগের। আমাদের মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, দৃষ্টিভঙ্গি এখন খাটো করে দেখা হচ্ছে। আমরাই এটা করতে দিয়েছি। কারণ এখন আমরা দুর্বল হয়ে পড়ছি।’

তিনি বলেছেন, ‘আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জড়িয়ে আছে একটি শক্তিশালী পরমাণু শক্তির দেশ। আর আমাদের সর্বক্ষণ সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। এটা ভালো বিষয় যে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পাশে আছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া দরকার, আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার এবং নিজেদের নিরাপত্তার ভার নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া দরকার। আমাদের অ-ইউরোপীয় দেশগুলো বন্ধু থাকবে, কিন্তু আমাদের যেন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচয়ে চলতে না হয়।’

ব্রিটেনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, ব্রেক্সিট তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে পারেনি। ব্রিটেনের সঙ্গে ফ্রান্স তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে। ল্যাঙ্কাস্টার হাউস ট্রিটিসহ দুপক্ষের অনেক শক্ত চুক্তি আছে। তিনি তার ভাষণে বহু জায়গায় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে থাকলে ইউরোপ অর্থনৈতিকভাবে আর দাঁড়াতে পারবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রই সেই দুধের সর খেয়ে ফেলবে। মাখোঁ আরও একটি বিপদের কথা উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাদের বন্ধু এবং এটা সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেশটিতে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা পরাজিত হলে ইউরোপ চরম সংকটে পড়তে পারে। তিনি বলেছেন, আগামীতে তিনি ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে এ নিয়ে জোর আলোচনা করবেন। ইউরোপের নিজেদের পরাশক্তিগুলোকে মোকাবিলা করতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি আধুনিক যুদ্ধবিমান, অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক এসব তৈরি করে থাকে এবং তা বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করে। তারপরও কেন মাখোঁ ইউরোপের প্রতিরক্ষার কথা বলছেন? তার মূল কথা হলো, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এর বলয় থেকে বের হওয়ার কথা বলছেন।

ইউরাপের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ইমানুয়েল মাখোঁর ভাষণটি খুবই বাস্তবমুখী। কোনো দেশের জন্যই পরনির্ভরশীলতা সুফল বয়ে আনে না। কিন্তু ইউরোপ কি পারবে একত্রিত হয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিজেরাই করতে? আপাতত মনে হয় না। কারণ ইউরোপের নেতাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে দ্বিমত আছে। এর একটি উদাহরণ হলো, হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ওরবান। ভিক্টরের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের তীব্র বিরোধ আছে মাইগ্রেশন পলিসি এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সমর্থন প্রশ্নে। হাঙ্গেরি একমাত্র দেশ, যা কি না সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদে আপত্তি জানিয়েছিল। ১৪ বছর ধরে ভিক্টর ওরবান হাঙ্গেরির ক্ষমতায় আছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট তাকে ‘নির্বাচিত স্বৈরশাসক’ বলে অভিহিত করেছিল। খুবই মজার বিষয় হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ঠিক আগে ভিক্টর ছিলেন ছাত্রনেতা। তখন রেড আর্মিকে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সাধারণ মানুষ। তার পুরস্কার হিসেবে ভিক্টর পশ্চিমাদের সহায়তায় রাজনীতির সামনের কাতারে চলে আসেন। এখন সেই ভিক্টর ওরবানই পশ্চিমা অনেক চিন্তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন। যে কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে ইউরোপীয় নেতারা যখনই জ্বালানিনীতি নিয়ে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে, ইউরোপের বিভিন্ন ফোরামে ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে বসেন, তখনই দেখা যায় তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা রয়েছে। ফলে মাখোঁ যেসব ইউরোপীয় দেশকে এক চিন্তায় নিয়ে আসতে পারবেন তা মনে হয় না।

২৩ এপ্রিল ৭৫ বছর বয়স্ক পর্তুগিজ প্রেসিডেন্ট মার্সেলো রেবেলো ডি সুজা এক বক্তব্যে বলেছেন, ১৫০০ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনে যে ট্রান্স-আটলান্টিক দাস ব্যবসা চলেছে, সেজন্য তার দেশের ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, আমরা পাপ করেছি। গত বছর ২৫ এপ্রিল ১৯৭৪ সালের পর্তুগিজ বিপ্লব দিবসেও তিনি দেশটির দায়িত্বের কথা বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, সাবেক কলোনিগুলোর কাছে যে ঋণ আছে, তা পরিশোধ করা উচিত এবং সাবেক উপনিবেশ দেশগুলোতে অর্থায়ন করা প্রয়োজন। ডি সুজা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এ ক্ষত ঢেকে রাখতে পারি না। যদিও পর্তুগিজ সরকার বলেছে, ‘আমাদের সাবেক উপনিবেশ দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সুসম্পর্ক রয়েছে, আমরা ঐতিহাসিক সত্যকে সম্মান করি, ভ্রাতৃপ্রতিম দৃষ্টিতে আমরা সহযোগিতার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো প্রক্রিয়া আমাদের হাতে নেই।’

এ সময়কালে ইউরোপীয়রা ১ কোটি ২৫ লাখ আফ্রিকানকে ধরে নিয়ে গেছে এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় দাস হিসেবে বিক্রি করেছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ আফ্রিকানকে পর্তুগিজ জাহাজে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ নিয়ে অনেক সাহিত্য ও স্মৃতিচারণ হয়েছে। অ্যালেক্স হেলির বিখ্যাত উপন্যাস রুটস সিনেমায় রূপ দেওয়া হয়, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। আফ্রিকার মানুষদের তখন গরু-ছাগলের চেয়েও নিম্নমানের প্রাণ হিসেবে দেখার কালচার ছিল। দীর্ঘকাল পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনি বিসাউ, ম্যাকাও, ব্রাজিল, কেপ ভার্দে, পূর্ব তিমুর এবং ভারতের কিছু অংশ। এখন সেই পর্তুগালের প্রেসিডেন্টই তাদের পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করছেন, আত্মোপলব্ধি হচ্ছে। গত বছর নেদারল্যান্ডস সাবেক কলোনিগুলোর কাছে ক্ষমা চেয়েছে। নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উদোদোর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এমনকি নেদারল্যান্ডসের রাজাও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন।

কিন্তু এখনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কারণ যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা ইউরোপের দেশগুলো এখন বহন করতে পারবে না বলেই অনেক ইউরোপীয় নেতা মনে করেন। এ নিয়ে আইনগত লড়াইও চলছে। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার ভলকার তুর্ক আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মানুষের ওপর উপনিবেশ শাসনের যে প্রভাব পড়েছে, তার দায় উপনিবেশ তৈরি করা দেশগুলো নিচ্ছে না।

অতীত অথবা বর্তমান যে সময়ের দুঃখজনক ঘটনার কথা আমরা বলি না কেন, এ উপলব্ধিগুলো রাষ্ট্রনায়কদের জন্য জরুরি। হয়তো শিগগিরই কোনো সমাধান হবে না। কিন্তু এ উপলব্ধি বলে দেয়, একটি রাষ্ট্র বা সমাজ আলোর মুখ দেখেছে। কারণ আলো ছাড়া সত্য দেখা যায় না। আত্মম্ভরিতা, অতিরঞ্জিত জাতীয়তাবাদ, অন্য জাতির প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন দৃষ্টি অন্ধকার সমাজেই বিদ্যমান থাকে। যেমনটা এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। এসব অঞ্চলে অতীত বা বর্তমান ভুল নিয়ে কেউ কখনো অনুশোচনা করে না। কারণ এখানকার সমাজ আত্মোপলব্ধি ও অনুশোচনা করতে শেখেনি।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যেভাবে দেখবেন বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ

অস্তিত্ব হারাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বলরাম হাড়ি মন্দির

ঘূর্ণিঝড়টি কোন দিক দিয়ে যাবে, জানা যাবে বুধবার

অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসছেন আজ

টিনশেড ঘরেই পাঠদান, রোদ-বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

সড়ক দুর্ঘটনায় কাভার্ডভ্যানচালক নিহত

ঝুঁকি নিয়েই লক্ষ্মীপুরের দুই উপজেলায় ভোট চলছে

কোপার স্কোয়াডে থাকছেন তো দিবালা?

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের রহস্য উদঘাটনে তদন্তে ইরান

ক্যানসারের কাছে হারলেন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা আরিফ

১০

মিনিস্টারের ‘হাম্বা অফার’, স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষলেই গরুসহ অসংখ্য ফ্রিজ ফ্রি

১১

মেষের ঝামেলার দিনে মিথুনের আর্থিক যোগ শুভ

১২

১১ মাস ধরে বন্ধ সড়কের কাজ, ভোগান্তিতে ৪ গ্রামবাসী

১৩

দুপুরের মধ্যেই ১২ জেলায় তীব্র ঝড়ের শঙ্কা

১৪

উপজেলা নির্বাচন / দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ শুরু

১৫

আজ যেসব এলাকায় ব্যাংক বন্ধ থাকবে

১৬

২১ মে : ইতিহাসের আজকের এই দিনে

১৭

নতুন ধান উদ্ভাবন, একবার রোপণে ফসল হবে পাঁচ বছর

১৮

মঙ্গলবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৯

শত নয়, সহস্র রাইসি তৈরি করে রেখেছে ইরান

২০
X