শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে এক সময়ের প্রমত্তা করতোয়া নদী। নদীর দুই তীরের জমির মালিকরা এখন নদীর বুকেই করছেন চাষাবাদ। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার পলাশী পয়েন্ট থেকে মহাস্থান ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার নদীতে চলছে বোরো আবাদ। কোথাও তৈরি করা হয়েছে বীজতলা, কোথাও রোপণ করা হয়েছে বোরো ধান, কোনো কোনো এলাকায় রয়েছে আলুর ক্ষেত। মাঝে মাঝে গভীর দু-এক জায়গায় পানির অস্তিত্ব দেখা গেলেও সেই স্থানটি ডোবার মতো, নেই কোনো প্রবাহ।
করতোয়া এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী নদী। প্রাচীন পুণ্ড্র সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এই নদীকে ঘিরেই। পরবর্তী সময়ে বগুড়া শহর ছাড়াও শেরপুর ও গোবিন্দগঞ্জের মতো প্রাচীন জনপদ গড়ে ওঠে এই নদীতীরে। এককালের উত্তাল প্রবহমান এই নদীর প্রাচীনত্ব এতটাই যে, ভারতীয় পুরাণেও এ নদীর উল্লেখ রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনি মতে, শিবের কর (হাতের তালু) নিসৃত জলধারা প্রবাহিত হয়েই করতোয়ার উৎপত্তি। শুধু তা-ই নয়, প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পুণ্ড্রবর্ধন নামে একটি রাজ্য ছিল। ওই রাজ্যের রাজা ছিলেন পরশুরাম। তার রাজধানী ছিল মহাস্থানগড়। ওই রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নাম করতোয়া। মহাস্থানগড়ে গেলে এখনো দেখা যায় করতোয়া নদীর জাহাজ ঘাটের স্মৃতিফলক। কথিত আছে এ করতোয়া নদীতেই রাজা পরশুরামের বোন শীলাদেবী আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। মহাভারতেও করতোয়া নদীর উল্লেখ আছে।
সেই বহমান নদী এখন শীর্ণকায় এক খালে পরিণত হয়েছে। কালের সাক্ষী এ নদীর বগুড়া অংশের উৎসমুখ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাখালী। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, আশির দশকের শুরুতে কাটাখালীর খুলসি পয়েন্টে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রেগুলেটার নির্মাণ করা হয়। মূলত এরপর থেকেই গতি হারাতে থাকে করতোয়া। এখন কাটাখালীতে নদীর উৎসমুখের তলদেশ অনেক উঁচু হওয়ায় সেখানে পানিপ্রবাহ বন্ধ। এ কারণেই দক্ষিণাংশের দীর্ঘ এলাকাজুড়ে এ মৌসুমে করতোয়া পানিশূন্য।
নদীর বুকে চাষাবাদ করে খুশি এলাকার কৃষকরা। শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুল্লাপুর গ্রামের কৃষক আজাহার মণ্ডল জানান, নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে অন্যান্য কৃষকের মতো তিনিও বোরো ধান রোপণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত বর্ষা-বাদল না হলে ৬ মাসের খোরাক ঘরে তুলতে পারব। সব বছর ধান ঘরে তোলা যায় না। দেখা যায় খুব বৃষ্টি হলে নদীর পানিতে সব ধান ডুবে শেষ। এজন্য আগেভাগেই ধান লাগাতে হয়। যেন বৈশাখ মাসের মধ্যেই ধান ঘরে তোলা যায়।’
মধুগঞ্জেশ্বরী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন, শহিদুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেন জানান, নদীতে উর্বর পলিমাটি থাকার কারণে সার-খৈলের প্রয়োজন হয় না। ভালো ফলনের জন্য নদীতে একেবারে পানি না থাকলে শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিতে হয়। নদীর ওপরে যাদের জমি আছে, তারাই সাধারণত নদীর জায়গা দখল করে ধান চাষ করে থাকেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা অংশের ৩৫ কিলোমিটার এলাকার তথ্য নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে নদীর ১০টি পয়েন্টে কিছুটা পানির অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে গুজিয়া, সাদুল্লাপুর, দেওয়ানতলা, আমতলী, শিবগঞ্জ হাটের পূর্বপাশ, উপজেলা সদরের চিকাদহ, পৌরসভার পেছনের অর্জনপুর, পার আচলাই, মহাস্থানের গোবিন্দভিটা ও শিলাদেবীর ঘাটে পানি আছে। এই ১০ পয়েন্টে পানির অস্তিত্ব থাকলেও তা প্রবহমান নয়। এসব স্থানে তুলনামূলক নদীর গভীরতা বেশি হওয়ায় ডোবার আকৃতি ধারণ করে পানির দেখা মিলছে। এ ছাড়া অন্য এলাকায় পানি একেবারে নেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে পাউবোর শিবগঞ্জ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ শাখার কর্মকর্তা আব্দুল হাই বলেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলা পর্যন্ত ১২৩ কিলোমিটার করতোয়া নদীর অবস্থাই করুণ। যেহেতু শিবগঞ্জ উপজেলার পাশেই রেগুলেটার নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে প্রভাবটা বেশি। করতোয়ার প্রাণ ফেরাতে ২ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘স্মার্ট করতোয়া রিভার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে যে প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে, সেটি পুরো অনুমোদন হলে করতোয়া আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে জানান তিনি।
আব্দুল হাই বলেন, ওই প্রকল্পের মধ্যে বগুড়া শহর অংশের ১৭ কিলোমিটারকে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে তা অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অবশিষ্ট অংশ অনুমোদন হলে ১২৩ কিলোমিটার নদীর বুকে আর চাষাবাদ করার কোনো সুযোগ থাকবে না।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, বর্তমান সময়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নদীগুলো তার রূপ ও যৌবন হারিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নদীতে পলি জমে ভরাট হওয়ার কারণে নাব্য হারাচ্ছে। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এলাকার কৃষকরা নদীতে ধান বীজ ও আলু রোপণ করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নদীগুলো খনন এবং অভিযান পরিচালনা করে দূষণ ও দখলদারিত্ব রোধের কার্যকারী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।