দেশে চলমান ‘মব সন্ত্রাস’ না থাকলে, আর সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হলে জাতীয় পার্টি (জাপা) আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা চিন্তা করবে। কালবেলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান দলটির নবনিযুক্ত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না বলে আশঙ্কা রয়েছে তার। তিনি অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং দলের রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা ও জুলাই-আগস্ট স্মৃতিচারণে মনোনিবেশ করেছে।
জাপা মহাসচিব বলেন, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে অনেকেই হীন রাজনীতি করছে, একঘরে করার চেষ্টা করছে, রাজনীতির মাঠের বাইরে রাখার প্রয়াস হচ্ছে। তবে এ প্রয়াসগুলো সফল হবে না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জাপা সঠিক পথই বেছে নেবে। যদি ‘মব সন্ত্রাস’ না থাকে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে, তবে জাপা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চিন্তা করবে। তবে এ বিষয়ে তৃণমূল ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেই দলের চেয়ারম্যান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
শামীম পাটোয়ারী বলেন, জাপার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বারবার আঘাত আসছে, তবু নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু জাপার রাজনীতি নিষিদ্ধ (ব্যান) করেনি, তাহলে ভোটে অংশ নিতে নিষেধ করবে কীভাবে? জাপার রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা না দিলে ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে একই সঙ্গে আশঙ্কা করছি, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না। সে ক্ষেত্রে দলের স্বার্থে, নেতাকর্মীদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি। জাপা অবশ্যই সবসময় নির্বাচনমুখী দল।
সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, রাজনৈতিক সরকারের মতো এই অন্তর্বর্তী সরকারের তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তারা দ্রুত সংস্কার করতে পারত, কিন্তু তা না করে তারা দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা, হন্টেড মেমোরিতে (মূলত জুলাই-আগস্টের স্মৃতি রোমন্থন) মনোনিবেশ করেছে। দেশ গঠনের একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল, যা তারা হারিয়ে ফেলেছে, খুবই দুঃখজনক। এ রকম সুযোগ এক যুগ, দুই যুগ পরে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার সব দলের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে পারত, কিন্তু তা তারা করেনি। এমনকি আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যেও ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার এত দলকে বাদ দিয়ে যে ঐকমত্য গঠন করতে চাচ্ছে, সেই ঐকমত্য তো মোটেও টেকসই হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান বাতিলের রায়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপযোগিতা আছে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, সেই সরকার পরবর্তী নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে, কিন্তু তা সফল হবে না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০১ ও ২০০৬-এর ঘটনাগুলো আমরা দেখেছি। এজন্য এই ব্যবস্থা দরকার আছে। দার্শনিক দিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও অবিশ্বাসের ফসল। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রয়োজনীয়তা আছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নির্বাচনী ব্যবস্থায় জাতি এখনো প্রস্তুত না। তবে উচ্চকক্ষে হাইব্রিড প্রক্রিয়ায় এটি পরীক্ষামূলকভাবে আংশিক চালু করা যেতে পারে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক মেরূকরণ নিয়ে তিনি বলেন, জাপা এই মুহূর্তে শুধু নিজের রাজনীতি নিয়েই ভাবছে। অতীতের সুবর্ণ ইতিহাস আর ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরবে। এর মাধ্যমে জাপা চেষ্টা করবে মানুষকে আকৃষ্ট করতে। এই মুহূর্তে কোনো জোটে জাপার ইচ্ছা নেই। তবে দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
দলের সাংগঠনিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, কিছুটা চ্যালেঞ্জিং সময়ে রয়েছে জাপা। তবে আমি মনে করি, রাজনীতি মানেই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। জাপা এরকম চ্যালেঞ্জ আগেও মোকাবিলা করেছে, এখনো করছে, সামনেও করবে। এভাবেই দল এগিয়ে যাবে। এজন্য যা যা করা প্রয়োজন তার সবই আমরা করব। আমরা বিভাগ, জেলা, সফর শুরু করব, এমনকি প্রতিটি ওয়ার্ডে হবে জাপার কমিটি। পুরোনো লোকজনদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেব, বিশেষ করে যারা নির্বাচিত ছিলেন, এর মাধ্যমে দল বিকশিত হবে। কিছু অপচেষ্টা থাকে আর এগুলো মোকাবিলা করেই দল খোলনলচে নতুনভাবে সংগঠিত করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করব।
পুরোনো লোকদের দলে ফিরিয়ে আনার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যে বা যারা নব্বইয়ের দশকে দলের ব্যানারে এমপি হয়েছিলেন, চেয়ারম্যান ছিলেন কিন্তু তারা পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন, এমন ব্যক্তিদের দলে সক্রিয় করে ফিরিয়ে আনা হবে। এসব জনপ্রিয় কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীকে ফিরিয়ে আনব। তৃণমূলের যেসব শাখায় এখনো কোনো কমিটি করা হয়নি তা পূরণ করাই প্রথম লক্ষ্য, যে যে শাখায় পুরোনো শক্তিশালী লোক আছে তাদের দায়িত্ব দেব। এর মাধ্যমে দলের কর্মকাণ্ড বেগবান হবে।
বহিরাঙ্গন কর্মসূচিতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কারও কর্মসূচি পালনে বাধা দিই না, তবে আমাদের কর্মসূচিতে কেউ কেউ বাধা দিচ্ছে যা তৃণমূল প্রতিহত করছে। সামনের দিনগুলোতে কেউ বাধা দিলে নেতাকর্মীরা নিশ্চুপ থাকবে না, প্রতিবাদ করবে, প্রতিহত করবে।
বহিষ্কৃতদের নিয়ে জাপা মহাসচিব বলেন, এ বিষয়টি অকস্মাৎ আমাদের সামনে আসে, রাষ্ট্রীয় কারণে আমাদের সম্মেলনের স্থানের বুকিং বাতিল করে দেওয়া হলো সেজন্য দলের চেয়ারম্যান কাউন্সিল স্থগিত করে দিলেন। কিন্তু সাবেক দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা বিবৃতি দিয়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে বিকল্প সম্মেলনের আহ্বান জানান। চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে সম্মেলন করার সুযোগ গঠনতন্ত্রে নেই। তাদের এ আহ্বানে তৃণমূল কোনোভাবেই সাড়া দেয় না। পরে বৈঠকে তৃণমূলের নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এই বিকল্প সম্মেলন ও বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দাবি জানান। এরপর প্রেসিডিয়াম বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে দায়ী তিনজনসহ বাকিদের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করে দেওয়া হয়। এটা তৃণমূলের সিদ্ধান্ত, প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত যা চেয়ারম্যান কার্যকর করেছেন। এখন একই তৃণমূল যদি কখনো আমাদের বহিষ্কৃতদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অনুরোধ জানায়, তখন বিবেচনা করা হবে। তৃণমূল বহিষ্কৃতদের দলে ফিরিয়ে আনতে আশু মতামত দেবে বলে মনে হয় না।
বহিষ্কৃতরা অনেকেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এজন্য তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আসলে কেন তারা চেয়ারম্যানকে বাদ দিতে বিকল্প সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন, বিকল্প বৈঠক করেছিলেন তা এখনো বোধগম্য নয়। এর পেছনে কোনো যোগসাজশ থাকতে পারে। জি এম কাদের যেহেতু বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচক, এজন্য তাকে অপদস্থ করে কেউ ভাবতে পারেন যে, সে বা তারা সরকারের আনুকূল্য পাবেন; কিন্তু রাজনীতির অঙ্ক বলে, এটা সঠিক হবে না।
নতুন দায়িত্ব গ্রহণ নতুন স্বপ্ন জাগায় জানিয়ে তিনি বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কর্মকাণ্ডগুলোকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেব। আমাদের লক্ষ্য সুদীর্ঘ রাষ্ট্র পরিচালনা, সংসদীয় ও তৃণমূলের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সব শাখাকে ঢেলে সাজিয়ে এবং ভিত্তি তৈরি সুসংহত করা। এর ভিত্তিতে ভোটে বিপুল সংখ্যক আসন অর্জন করে সরকার গঠন ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখা।
মন্তব্য করুন