কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩, ০৯:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সশস্ত্র জিহাদ করতে চেয়েছিল শারক্বীয়া

গ্রেপ্তারের পর সস্ত্রীক শামীন মাহফুজ।
গ্রেপ্তারের পর সস্ত্রীক শামীন মাহফুজ।

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র জিহাদ করা। সংগঠনটি মনে করে, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কাজ করে তারা মুরতাদ। এজন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করতে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের (কুকি-চিন) আস্তানায় অস্ত্র প্রশিক্ষণও নিয়েছিল সংগঠনটির সদস্যরা। নতুন ওই জঙ্গি দলের প্রতিষ্ঠাতা শামীন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা। কেএনএফের সঙ্গে সংগঠনটি অস্ত্র প্রশিক্ষণের যে লিখিত চুক্তি করেছিল, সেটিও উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

গত বছর কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণরা ঘর ছাড়লে সামনে আসে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নাম। এর পর থেকেই সংগঠনটির সদস্যদের গ্রেপ্তারে টানা অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ ও র্যাব। দেশের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও বান্দরবানে চলছে র্যাবের যৌথ অভিযান। এ পর্যন্ত সংগঠনটির অর্থ, অপারেশন ও মিডিয়া শাখার প্রধানসহ প্রায় ১০০ সদস্য গ্রেপ্তার হলেও এবার প্রতিষ্ঠাতা শামীন মাহফুজ ও তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলো।

সিটিটিসি সূত্র জানিয়েছে, নাজনীন শামীন মাহফুজের দ্বিতীয় স্ত্রী। তার প্রথম স্বামী জঙ্গি ইজাজ আহমেদ পাকিস্তানে কথিত জিহাদে গিয়ে নিহত হয়। কারগিল যুদ্ধে ড্রোন হামলায় আনসার আল ইসলামের এ জঙ্গি নিহত হওয়ার পর তার নামের পাশে কারগিল শব্দটি যুক্ত হয়। এই ইজাজ কারগিলের মৃত্যুর পর শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের নির্দেশে শামীন নাজনীনকে বিয়ে করেন।

গতকাল শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে শামীন মাহফুজ ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সিটিটিসি কর্মকর্তারা। সেখানে জঙ্গি ও উগ্রবাদ দমনে গঠিত ঢাকা মহানগর পুলিশের এ সংস্থার প্রধান এবং অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামীন মাহফুজকে গ্রেপ্তারে তারাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে অভিযান চালাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার রাতে জানতে পারেন, ওই জঙ্গি নেতা ডেমরায় নিজেদের আস্তানায় আসছে। তখন তাকে স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময়ে বিদেশি পিস্তল ও বিস্ফোরক জব্দ করা হয়।

সিটিটিসি প্রধান জানান, তারা শামীনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তার কাছে পাওয়া ব্যাগ ও মোবাইল ফোন তল্লাশি করেছেন। এ থেকে নেটে তাদের গোপন কথোপকথনের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। ওই কথোপকথনে সংগঠনটির শূরা কমিটির সঙ্গে কেএনএফ প্রধান নাথান বমও সংযুক্ত ছিল।

শারক্বীয়ার সদস্যদের গ্রেপ্তার অভিযানের শুরুর দিকে ওই কনভারসেশন হতে পারে জানিয়ে সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই কথোপকথনে শামীন মাহফুজকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয় নাথান বম। কিন্তু শামীন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নাকচ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শামীন নির্দেশনা দেয়, ‘যুদ্ধ হবে আক্রমণাত্মক, রক্ষণাত্মক নয়।’

সিটিটিসি প্রধান বলেন, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র জিহাদ করা। তাদের মতে, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কাজ করে তারা মুরতাদ। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই মূল উদ্দেশ্য। তবে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত।

তিনি বলেন, আলোচিত জঙ্গি সংগঠন আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মূল ব্যক্তি শামীন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হবে বলেও তারা মনে করছেন।

ছাত্রশিবির থেকে শীর্ষ জঙ্গি নেতা মেধাবী শামীন : সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, ছাত্রজীবন থেকেই শামীন মাহফুজ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। গাইবান্ধায় জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তি এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন, এরপর রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়াকালীন ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর অন্য একটি কলেজে ভর্তি হলেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। এইচএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে সপ্তম স্থান অর্জন করেন। শামীনের বাবাও গাইবান্ধার একটি উপজেলায় জামায়াতের কৃষক শাখার সভাপতি ছিলেন।

সিটিটিসিপ্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরই বড় ভাইয়ের ছেলের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে জড়ান শামীন। যে সংগঠনটি পরে আনসার আল ইনলাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মেধাবী হওয়ার কারণে ২০০৭ সাল থেকেই শামীন মাহফুজ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ শীর্ষ নেতৃত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

যেভাবে পাহাড়ে চোখ পড়ে এ জঙ্গির : সিটিটিসি প্রধান জানান, ঢাবিতে পড়াকালে জঙ্গিবাদে জড়িয়েই শামীন পাহাড়ে ক্যাম্পের পরিকল্পনা করেন। তার বন্ধু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাথান বমের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে সখ্য গড়েন এ মেধাবী। তার মাধ্যমে তিনি পাহাড়ে যান। পড়ালেখা শেষ করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরুও করেন। এর মধ্যেই তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে এনরোলমেন্ট হয়। তার গবেষণার বিষয় ছিল পাহাড়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। ইচ্ছা করেই তিনি এ বিষয়টি নেন, যাতে তিনি পাহাড়ে যেতে পারেন এবং সেখানে নিরাপদ আস্তানা তৈরি করতে পারেন।

শামীন মাহফুজ ২০১১ সালে বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, জেল থেকে বেরিয়ে একই কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। ২০১৪ সালে ঢাকার ডিবি আবারও তাকে গ্রেপ্তার করে। তখন কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। সেখানে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের প্রথম পরিকল্পনা হয়। বন্দি হুজি এবং জেএমবির শীর্ষ নেতা সাইদুর রহমান, আবু সাঈদ ও মওলানা ইয়াহিয়ার সংস্পর্শে আসেন। তখন শারক্বীয়ার প্রথম আমির রক্সিও জেলখানায় ছিলেন।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই সময় জঙ্গি নেতারা জানতেন শামীন মাহফুজ এবং রক্সি আগেই জেল থেকে বের হবে। তাই তাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির। ২০১৭ সালে রক্সি এবং ২০১৮ সালে শামীন মাহফুজ জেল থেকে জামিনে ছাড়া পান। এর পর থেকে তারা সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। তারা একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে থাকেন। রক্সি দাওয়াতি কার্যক্রম এবং শামীন পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তখন ২০১৯ সালে রক্সিকে সংগঠনের আমির হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ওই বছরই শামীন তার বন্ধু নাথান বমকে (কেএনএফ প্রধান) জঙ্গি সংগঠন তৈরির কথাটি জানান এবং সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতের জন্য তাকে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব দেন।

সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, ২০২০ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে কেএনএফ ও নতুন জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক হয়। শামীনের কাছ থেকে হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার স্মারকটি উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে কেএনএফ কর্তৃক জঙ্গি সংগঠনটিকে সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। তখন থেকেই ওই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটির আওতায় তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। রক্সিকে গ্রেপ্তারের পর মূল ব্যক্তি হিসেবে তমালকে আমির হিসেবে নিয়োগ দেন শামীন। ২০২২ সালে সুরা কমিটি গঠন করে বিভিন্ন জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সিটিটিসি প্রধান বলেন, নাথান বমের সঙ্গে শামীনের সর্বশেষ যোগাযোগটা উদ্ঘাটন করা যায়নি। তবে মনে করা হচ্ছে, কোনো না কোনোভাবে তার যোগাযোগ থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে শামীনকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

নাথান বমের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন শামীন জানিয়ে তিনি বলেন, তার কথায় কেন নাথান বম আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তারেক রহমানের বার্তা নিয়ে কয়রায় বাসস চেয়ারম্যান আনোয়ার আলদীন

৩৮ বছর বয়সে স্বপ্নপূরণ আব্বাস আফ্রিদির

চট্টগ্রামে এনজিও কর্মকর্তার ১০ বছর কারাদণ্ড

সহকারী কমিশনার শফিকুলের নিয়োগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন

ক্রিকেটে বিরল মুহূর্ত : বাংলাদেশ না বুঝেই পেয়ে গেল শ্রীলঙ্কার উইকেট

‎আলোচিত সেই পর্ন তারকাকে নিয়ে যা বললেন এলাকাবাসী

সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড নিয়ে যে আলোচনা হলো

২ বছর পর খুলল স্কুল, গাজার ৩ লাখ শিশুর পড়ালেখা শুরু

শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্কুলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কঠোর বাস্তবায়ন দরকার

রিশাদকে টেস্টে দেখতে চান মুশতাক

১০

ছাত্রদলের ব্যতিক্রমী উদ্যোগে ছোট নামাজিদের মুখে হাসি

১১

প্রবাসীদের পাসপোর্ট ফি নিয়ে সুখবর দিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১২

চসিকের সাবেক প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে দুদুকের চার্জশিট

১৩

মিরপুরের কালো মাটির উইকেটে স্পিনারদের যে পরামর্শ দিলেন মুশতাক

১৪

সাংবাদিক সুভাষ সিংহসহ ১০ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

১৫

২৩ বছরের অপেক্ষা নারীর, কারাগার থেকে ফিরেই বিয়ে করলেন ফিলিস্তিনি

১৬

পর্ন তারকা যুগল নিয়ে সামনে এলো আরও অজানা তথ্য

১৭

হাত-পায়ের রগ কাটা শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার

১৮

বৃষ্টি-লঘুচাপ নিয়ে নতুন বার্তা আবহাওয়া অফিসের

১৯

জবি ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ খুন, আটক ৩

২০
X