বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে রাজপথে ফের সক্রিয় হচ্ছে বিএনপি। এই ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এর অংশ হিসেবে শিগগির ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশের কর্মসূচি পালন করা হবে। সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে কর্মসূচির দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে কর্মসূচির প্রকরণও ঠিক হয়নি। আজ বুধবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় দল ও অঙ্গ সংগঠনের যৌথসভায় তা চূড়ান্ত হবে। এরপর সংবাদ সম্মেলনে সেই কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী তিন দিনের সমাবেশের কর্মসূচি দিতে পারে দলটি। আগামী শুক্র অথবা শনিবার ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হতে পারে। এরপর একই দিনে ঢাকার বাইরে সব মহানগরে এবং পরবর্তী সময়ে সব জেলায় একই দিনে সমাবেশ হতে পারে।
কর্মসূচি প্রসঙ্গে দলের এক যুগ্ম মহাসচিব ও এক সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, প্রথমে ঢাকায় সমাবেশ হবে, যা আগামী শুক্র অথবা শনিবার হতে পারে। এরপর ঢাকার বাইরে মহানগর ও জেলা পর্যায়ে সমাবেশ হতে পারে, যা যৌথসভায় চূড়ান্ত হবে। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যায়, শুক্রবার ঢাকায় সমাবেশ হলে পরদিন শনিবার ঢাকার বাইরে সব মহানগরে হবে। অন্যদিকে ঢাকায় শনিবার সমাবেশ হলে সেক্ষেত্রে রোববার মহানগরগুলোতে হতে পারে। পরপর তিন দিন কর্মসূচি হতে পারে অথবা মাঝখানে একদিন গ্যাপ দিয়েও হতে পারে। আবার কর্মসূচি দুদিনেরও হতে পারে। সেক্ষেত্রে মহানগর ও জেলা পর্যায়ে একই দিন সমাবেশ হতে পারে।
জানা গেছে, ঢাকায় দলীয় চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তির সমাবেশ ঘিরে বড় শোডাউনের পরিকল্পনা করছে বিএনপি। এই কর্মসূচিতে দলের ঢাকার দুই মহানগর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলা ও মহানগরগুলো থেকেও নেতাকর্মীরা আসবেন। অংশ নেবেন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগমের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে চায় দলটি। খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও নিঃশর্ত মুক্তিসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সর্বশেষ গত ১০ মে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও মিছিল করে বিএনপি।
এদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়াও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং ছাগলকাণ্ডে আলোচিত রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ সরকার ও ক্ষমতাঘনিষ্ঠদের দুর্নীতি ও লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ আরও বেশ কিছু ইস্যুতেও কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। এ ছাড়া সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ‘চুক্তি-সমঝোতাগুলো’কে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অভিহিত করে এর বিরুদ্ধেও আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে দলটি। ঈদুল আজহার পর এর মধ্য দিয়ে রাজপথের কর্মসূচিতে নামতে যাচ্ছে বিএনপি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দলের স্থায়ী কমিটির সভায় বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই লক্ষ্যে শিগগির প্রয়োজনীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা রাজপথে রয়েছি। খালেদা জিয়া হচ্ছেন গণতন্ত্রের প্রতীক। তাকে মুক্ত করার অর্থ প্রাথমিকভাবে গণতন্ত্র মুক্ত করার মতোই। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন থেকে সরে যাইনি, বেগম জিয়ার মুক্তির আন্দোলন থেকেও সরে যাইনি, এটা বাস্তবতা।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সি (খালেদা জিয়া) ইজ সিম্বল অব ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট। দুই আন্দোলনকে আলাদা করে দেখা যাবে না। সরকারের নিবর্তনমূলক, নির্যাতনমূলক দমননীতির কারণেই আন্দোলনে হয়তো বা সাফল্য আসেনি এখন পর্যন্ত। কিন্তু কোনোদিনই ন্যায়ের পথে আন্দোলন ব্যর্থ হয় না, আমাদের এটাতেও অবশ্যই সাফল্য আসবে।’
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তিনি। ওই সময় আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী মানববন্ধন, অবস্থান, গণঅনশন, লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ সমাবেশ, সমাবেশসহ নানান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। পরে করোনা মহামারিকালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাময়িক স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। কারামুক্তির পর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় থাকছেন শারীরিকভাবে অসুস্থ খালেদা জিয়া। এর আগে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে তার পরিবার থেকে সরকারের কাছে একাধিকবার আবেদন করা হলেও অনুমতি পাওয়া যায়নি। প্রতিবারই কারামুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাকে দেশে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। তাকে বাসায় থাকার সুযোগ দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে আছেন, বন্দি আছেন। দলের মহাসচিব বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে আগে খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হলো এবং তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর থেকে তিনি যাতে কোনোমতেই মুক্তি না পান, তা চলছে এখন পর্যন্ত।
৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হওয়ায় মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে তার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়। নতুন করে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের এই অবনতিতে কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এর আগে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে নানান কর্মসূচি পালন করলেও এবার শুধু তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হবে দলটি। বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়া পুরোপুরি মুক্ত হলে তখন পছন্দ অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন।