কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৪ এএম
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্গাপূজা ও সামাজিক মূল্যবোধ

চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী
দুর্গাপূজা ও সামাজিক মূল্যবোধ

সনাতন ধর্মের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। প্রতি বছর আশ্বিনের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত বঙ্গদেশে তা সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য পৃথিবীতে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন। বাংলাদেশে রাজশাহী জেলার অন্তর্গত তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম এ দুর্গোৎসব বাংলাদেশে প্রচার করেন। এরপর তা ক্রমবর্ধমান হতে হতে সমগ্র বঙ্গদেশে বিস্তার লাভ করে। দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, অধিকন্তু তা আমাদের সনাতন সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশের ধারক ও বাহক।

অনন্ত শক্তিধর পরমেশ্বর ভগবানের প্রধান তিন শক্তি—চিৎশক্তি, জীবশক্তি ও মায়াশক্তি; এর মধ্যে মায়াশক্তিই ভুবনপূজিতা দুর্গা। ভগবান শ্রীনারায়ণ বা শ্রীবিষ্ণুর শক্তি বিধায় তিনি নারায়ণী ও বৈষ্ণবী নামে অভিহিত। তিনি প্রকৃতিস্বরূপা এবং এই জড়া প্রকৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সৃষ্টিকালে পরমেশ্বরের (মহাবিষ্ণুর) ইচ্ছা ও চিন্ময় দৃষ্টিপাতের ফলে প্রকৃতি থেকে আমাদের জন্ম হয়। তাই দেবী দুর্গা হলেন জগন্মাতা।

জড় জগৎরূপ দুর্গের অধ্যক্ষ তিনি, তাই তাকে দুর্গা বলা হয়। মহামায়ারূপে তিনি জীবকে মায়াগ্রস্ত করেন, আবার, যোগমায়ারূপে তিনিই জীবকে মায়ামুক্ত হতে এবং ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হতে সহায়তা করেন। হরিবিমুখ ও হরিবিদ্বেষী জীবদের জন্য তিনি দুর্গতিদায়িনী, অসুরদলিনী; আবার হরিভক্তিপরায়ণদের জন্য তিনিই দুর্গতিনাশিনী। শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুসারে, বিষ্ণুকর্তৃক বধের উদ্দেশ্যে মধু ও কৈটভ নামক দৈত্যকে মোহিত করার জন্য ব্রহ্মার প্রার্থনায় দেবী দুর্গা প্রকটিত হন। আবার এক সময় মহিষাসুরের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলে তাকে প্রতিহত করার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবসহ সমস্ত দেবতার তেজ থেকে দেবী দুর্গা প্রকাশিত হন এবং পরমেশ্বর ভগবান তার বহিরঙ্গাশক্তি দুর্গার দ্বারা মহিষাসুরকে বধ করে দেবতাদের সুরক্ষা প্রদান করেন। তাই আসুরিক শক্তির বিনাশ এবং শান্তিময় পৃথিবী উপহার দিতেই মা দুর্গার আবির্ভাব।

সমাজের সব স্তরের নারীকে মাতৃজ্ঞানে মর্যাদা দান করা হয় এই দুর্গাপূজায়। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে (১১.৬) বলা হয়েছে—তব দেবি ভেদা স্ত্রীয়ঃ সমস্তা সকলা জগৎসু। অর্থাৎ, পাতিব্রত্য, সৌন্দর্য ও তারুণ্যাদি গুণান্বিতা সব নারীই মা দুর্গার অংশসম্ভূতা। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও প্রকৃতিখণ্ডে (১.১৩৯) বলা হয়েছে, Ñ

কলাংশাংশসম্ভুতাঃ প্রতিবিশ্বেষু যোষিতঃ।

যোষিতামপমানেন প্রকৃতেশ্চ পরাভবঃ ॥

“এ জগতে স্ত্রীগণ প্রকৃতির কলাংশের অংশ হতে উৎপন্না। অতএব, স্ত্রীগণের অপমানে প্রকৃতি তথা দুর্গাই অপমানিতা হন।”

সনাতন ধর্মে পরস্ত্রীকে মাতৃবৎ সম্মান করার কথা বলা হয়েছে মাতৃবৎ পরদ্বারেষু। প্রখ্যাত মাতৃসাধকগণ, যারা দেবীর আরাধনা করে সিদ্ধি লাভ করছেন, তাদের নৈতিক চরিত্র অনেক উন্নত ছিল। তারা সর্বস্তরের নারীকেই দেবীর অংশজ্ঞানে মাতৃরূপে সম্মান করতেন। পরস্ত্রীকে যদি সবাই ওইরূপ দেবীর অংশস্বরূপ মাতৃজ্ঞানে সম্মান করেন, তবে সমাজ হবে কলুষমুক্ত। দুর্গাপূজা আমাদের চিত্তে সেই মূল্যবোধ ও আদর্শকে উজ্জীবিত করে।

আবার দেবী দুর্গা জগন্মাতা হওয়ায় প্রত্যেক জীব তার সন্তান; অর্থাৎ আমরা সবাই একে অন্যের আত্মীয়স্বরূপ। সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা এবং একটি শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পৃথিবী গড়ার জন্য আমরা যে বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলি, দেবী দুর্গাকে জগন্মাতারূপে অর্চনা করার মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে সেই চেতনা বিকশিত হয়।

দুর্গাপূজায় ধনী-দরিদ্র, নারী-শিশু-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী তথা সর্বস্তরের মানুষ বৈষম্য ও ভেদাভেদ ভুলে সম্মিলিত হয়; তৈরি হয় সম্প্রীতির মেলবন্ধন। এ প্রাণের উৎসবে শাস্ত্রীয় বাদ্যগীত, দেবী মায়ের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান ও প্রার্থনা, ভোগ ও আরতি নিবেদন, একে অন্যের বাড়ি যাওয়া, প্রসাদ পাওয়া, উপহার প্রদান প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

অতএব, বিভিন্নভাবে দুর্গাপূজা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ বিকশিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই বর্তমানে দুর্গাপূজা বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক বিশেষ উৎসবে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইউনেসকো কর্তৃক ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দুর্গাপূজা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই স্বীকৃতি বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের গৌরব ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। এখন তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আমাদেরই সচেষ্ট থাকতে হবে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক

ইসকন, বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিয়ের প্রলোভনে ‘ধর্ষণ’, পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার

পরীক্ষায় নকল সরবরাহ করতে যান ছাত্রদল নেতা, অতঃপর...

ছাত্রীদের হলে পুরুষ স্টাফ দিয়ে তল্লাশি

দাম কমলো ইন্টারনেটের

ইসরায়েলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা উপযোগী, ভাবার অনুরোধ তারেক রহমানের

বৈষম্যবিরোধী নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ

জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ

শাহজালালে বোয়িং বিমানে লাগেজ ট্রলির আঘাত

আখতারকে রংপুর-৪ আসনে এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা

১০

মধ্যরাতে বরখাস্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার

১১

‘একসঙ্গে সমুদ্রে নেমে তো গোসল করতে পারব না’

১২

জুলাই যোদ্ধার তালিকায় এক ব্যক্তির নাম ২ জায়গায়

১৩

বিএনপির অনুষ্ঠানে অপ্রীতিকর ঘটনায় মির্জা ফখরুলের প্রতিবাদ

১৪

রাজধানীতে শ্রমজীবী মানুষের মাঝে লায়ন্স ক্লাবের খাবার বিতরণ

১৫

জামায়াত-গণঅধিকার পরিষদের মতবিনিময় / নির্বাচনী জোট গঠনে একমত

১৬

উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ, মাদ্রাসার সুপার কারাগারে

১৭

তারেক রহমান নেতৃত্ব না দিলে জুলাই আন্দোলন সফল হতো না : মুরাদ

১৮

চট্টগ্রাম নগরীতে ইউপিডিএফ সদস্য গ্রেপ্তার

১৯

‘প্রেমে ব্যর্থ হলে বাথরুম পরিষ্কার করি’

২০
X