ব্যান্ড রকসল্ট। তাদের কাছে সংগীত শুধু শব্দ নয়, একটি অনুভূতির প্রতীক। তাদের চাওয়া গানের সুরের মধ্য দিয়ে মানুষ তার নিজের আবেগকে খুঁজে পাক, অনুভব করুক যে তারা একা নয়। এ প্রত্যাশা নিয়ে এরই মধ্যে দেশের রক মিউজিকে নাম লিখিয়েছে তারা। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তরুণ রক মিউজিশিয়ানদের নিয়ে শুরু হওয়া ‘দ্য কেইজ’ রিয়েলিটি শোয়ে। যেখানে সারা দেশ থেকে বাছাই করা শতাধিক প্রতিযোগীর মধ্যে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয় ৮০ জনকে। তারা গঠন করেন ১৭টি ব্যান্ড। গ্রুমিং শেষে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ছয়টি ব্যান্ড পৌঁছায় ফাইনালে। সেখান থেকেই চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতেছে ‘রকসল্ট’। আয়োজনে বিচারক হিসেবে ছিলেন অ্যাভয়েড রাফা ব্যান্ডের ভোকাল রাফা, ওয়ারফেজের পলাশ নূর, আরবোভাইরাসের গিটারিস্ট রঞ্জন এবং সংগীতশিল্পী তাসফি।
নিজেদের এ যাত্রা নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা হয় ব্যান্ডটির। নিচে তাদের অনুভূতির কথা তুলে ধরেছেন মহিউদ্দীন মাহি
সৈয়দ আরিফুল ইসলাম আওয়ান (ড্রামার)
ছেলেবেলা থেকেই তালবদ্ধ বাদ্যযন্ত্র—তবলা, ঢোল, পারকাশন, ড্রামস—এসবের প্রতি আমার ছিল আলাদা এক আকর্ষণ। পরিবার ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি, আর প্রবল ইচ্ছাশক্তিই আমাকে নিয়ে আসে দ্য কেইজ প্রতিযোগিতায়, যেখানে রকসল্টের সঙ্গে শুরু হয় আমার নতুন পথচলা। ব্যান্ড রকসল্টের ড্রামার ও লিরিসিস্ট হিসেবে শুরু থেকেই নিজের দায়িত্বটা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। সিজন ১-এর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে আমরা মাত্র পাঁচ মাসেই ছয়টি মৌলিক গানের কম্পোজিশন শেষ করি, যা শিগগির রিলিজ পেতে যাচ্ছে।
এই রকসল্টের সঙ্গে ড্রামস বাজিয়ে আমি সেই স্বীকৃতিটা পেয়েছি, যা অনেক শিল্পীর চাওয়া হয়ে থাকে। দেশের গুণী অনেক ব্যান্ড তারকা আমাদের প্রশংসা করেছেন—এ স্বীকৃতিগুলো ভবিষ্যতের পথ চলায় অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। ২০২৬-এর মধ্যে আমাদের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের লক্ষ্য রয়েছে। ছোট বয়সে এমন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। শিল্পই আমার যাত্রা, রকসল্ট আমার আরেকটি পরিবার।
মো. সৈয়ব রেজা রাজীব (বেজিস্ট)
মিউজিকের শুরু ড্রামস দিয়ে ২০০৬ থেকে, দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার পর ২০২১ সাল থেকে ড্রামস বাজানোর পাশাপাশি পুরোপুরি বেজ গিটার বাজানো শুরু হয়, মনের ভেতর সুপ্ত যে বাসনা ছিল তার প্রতিফলন ঘটে দ্য কেইজ প্রোগ্রামের মাধ্যমে, নিজেকে আবারও চেনা, মনের মতো ব্যান্ড সদস্য খুঁজে পাওয়া এবং রকসল্টের গঠন হওয়া, দ্য কেইজে প্রতিযোগিতা করা এবং সর্বশেষ বিজয়ী হওয়া সবই স্বপ্নের মতো, যাদের মিউজিক শুনে নিজেকে মিউজিশিয়ান ভাবার স্বপ্ন দেখেছি তাদের কাছে পাওয়া, এ এক অবিশ্বাস্য পথচলা ছিল, সঙ্গে শুরু হলো আমাদের চ্যালেঞ্জ রকসল্টকে দেশের প্রতিটি প্রান্তরে পৌঁছে দেওয়া; আমাদের গানের মাধ্যমে, আমি চাই আমাদের গানগুলো শুধু এ প্রজন্ম নয়, পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুনুক, সে ধরনের গান তৈরি করতে চাই।
সাজ্জাদ আল নাহিয়ান (ভোকাল)
আমার আলাদা কোনো গল্প নেই। সেই পুরোনো কলমের কালি আর শ্যাওলা পড়া কাগজের কাহিনিই আমার গল্প। বরিশাল শহরে আমার বেড়ে ওঠা। মা আর আমি মিলে আমাদের ছোট্ট সংসার। সংগীত জীবনে আমার পা ফেলা মায়ের হাত ধরেই—বলতে দ্বিধা নেই, তার থেকেই আমি গানের গলা পাই। এবার আসি আমার ‘দ্য কেইজ’-এর যাত্রার কথায়। প্রথম যখন অডিশন দিই, তখন এত কিছু ভাবিনি—যে একটা ব্যান্ড হবে বা জিততেই হবে। শুধু মাথায় ছিল শিখতে হবে, নিজেকে ভাঙতে হবে। বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে মূল পর্বের এক অভিজ্ঞতা নিয়ে যাওয়ার সময় শুনলাম, আমার গান বিচারকদের পছন্দ হয়েছে। মনের ভেতর শান্তি আর ভয়—দুটিই ছিল। তবে যখন ব্যান্ড তৈরির দিন আসে, সৃষ্টিকর্তা কীভাবে যেন মনের মতো চারজনকে আমার জীবনে নিয়ে আসেন। দেখতে দেখতে নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা ‘রকসল্ট’ উপহার পেলাম। সারা জীবন আমি যেখানে লালন সাঁইজির চর্চা করছিলাম, সেখানে আজ আমি মেটাল এবং রক অ্যান্ড রোলের মতো গানও চর্চা করি। জীবনের এ ছোট ছোট ব্যাপারই আসলে আমাকে পরিপূর্ণ এক আমিতে রূপান্তর করছে। আমি নিজেকে কখনো একজন গায়ক নয়, বরং বরাবরই একজন শিল্পী হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। কারণ, একাধারে আমি আমার সারা জীবন নিজের সঙ্গে আর চারপাশের পরিস্থিতির সঙ্গে অভিনয়, সুরের সঙ্গে যুদ্ধ এবং মঞ্চে উঠে নিজেকে ভেঙে আবার গড়ে তুলেছি। জীবনের একটা শেষ ইচ্ছা হলো—একটা ফাঁকা অডিটোরিয়ামের মঞ্চে আমি একাই বিলাপ করব, তবে কেউ থাকবে না। সেখানেই যেন আমি সার্থক। সবশেষে বলতে চাই একটাই কথা—‘ধন্যবাদ সবাইকে, যারা আমাদের পাশে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। অতীত কখনো অস্বীকার করা যাবে না।’
অরুপ চৌধুরী (লিড গিটারিস্ট)
আমি ছয় বছর বয়স থেকে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছি, আর গত প্রায় তিন বছর ধরে গিটার বাজাচ্ছি। সংগীতকে আমি সবসময়ই ভালোবেসেছি, নিঃস্বার্থভাবে। কখনোই সংগীত থেকে কিছু পাওয়ার আশায় সংগীত করিনি—এ ভালোবাসা ছিল নিঃশব্দে নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করার একটি পথ। ‘দ্য কেজ’-এ নির্বাচিত হওয়া এবং বিজয়ী হওয়া আমার জন্য সত্যিই এক স্বপ্নপূরণের মতো অনুভূতি। কখনো ভাবিনি সংগীত আমার জীবনকে এমনভাবে ছুঁয়ে যাবে। আমি নিজের ওপর কখনোই শতভাগ বিশ্বাস রাখতে পারিনি, কিন্তু যারা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন—তাদের বিশ্বাসটাই ছিল আমার চালিকাশক্তি। তাদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
‘রকসল্ট’ শুধু একটি ব্যান্ড নয়, আমার পরিবার। এই পরিবারের সঙ্গে আমি চাই মানুষ বুঝুক—সংগীত শুধু শব্দ নয়, এটি অনুভূতির প্রতীক। আমি চাই আমার সুরের মধ্য দিয়ে মানুষ তার নিজের আবেগকে খুঁজে পাক, অনুভব করুক যে তারা একা নয়। যাদের হৃদয়ে একই সুর বাজে, তারা যেন ‘রকসল্ট’-এর সংগীতের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারে, অনুপ্রাণিত হতে পারে।
রাযিন মুহতাদী শিহাব (গিটারিস্ট)
ছোটবেলায় যখন চার বছর বয়সে তবলা শিখতে গিয়েছিলাম, তখন সংগীত চর্চা আমার কাছে প্রায় অসম্ভব মনে হতো। সেই অনুভূতিটা এতটাই তাড়না দিত যে, ষোলো বছর বয়সে প্রথম বেস গিটার হাতে তোলা পর্যন্ত আমি সংগীতকে এড়িয়ে চলেছি। তারপর থেকে মন যেটা চেয়েছে, সেটাই বাজিয়েছি—যেমন করে হৃদয় ইশারা করেছে। এই যাত্রা, যা শেষ পর্যন্ত দ্য কেইজ আর রকসল্টের মতো পথচলায় রূপ নিল, আমি কখনো ভাবিনি যে এর অংশ হতে পারব। এখন রকসল্ট নিয়ে যা করি, তার মাধ্যমে আমি সহমর্মিতার সীমানা আরেকটু প্রসারিত করতে চাই। আমাদের গানের মাধ্যমে মানুষ যেন বুঝতে পারে—জীবনের লড়াইয়ে কেউ আসলে একা নয়। অভিজ্ঞতা যত ভিন্নই হোক, অনুভব করার শক্তি আমাদের এক করে; সেই মানবিক স্পর্শটাই ছুঁয়ে দিতে চাই শ্রোতাদের মনে।
মন্তব্য করুন