কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০২:১৬ এএম
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

লারমার সমাজ দর্শনকে গুরুত্ব দিতে হবে

ঢাবির আরসি মজুমদার মিলনায়তনে মতবিনিময় সভায় বক্তারা। ছবি : কালবেলা
ঢাবির আরসি মজুমদার মিলনায়তনে মতবিনিময় সভায় বক্তারা। ছবি : কালবেলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের লারমার সমাজ দর্শনকে গুরুত্ব দিতে হবে। অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, এই সংবিধান একটি সামন্তবাদী সংবিধান। যে সংবিধানকে ভেঙে এমএন লারমা, সন্তু লারমারা বের হয়ে উঠে আসতে চেয়েছেন। এই সংবিধান কেবল বাঙালির, অন্য কোনো জাতির স্থান দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, দেশের সংবিধানে, রাষ্ট্র সিস্টেমে বহুত্ববাদের স্থান দেওয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশ একটি বহুভাষা, বহুজাতির, বহু সংস্কৃতির দেশ। আমরা যে বহুত্ববাদী সংবিধানের কথা বলি সে বহুত্ববাদী সংবিধান হতে গেলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সমাজ দর্শনকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, দেশের সব সিস্টেম স্বৈরাচারী বানানোর পথ খোলা করে রেখেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শুধু মানুষ বদলেছে, সিস্টেম বদলায়নি।

মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে ‘সংবিধান দর্শন : জুলাই গণঅভ্যুত্থান, রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী জাতিগুলোর অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

আইপিনিউজের উপসম্পাদক সতেজ চাকমার সঞ্চালনায় ওই বাহাস ও মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ। আলোচক ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, কবি ও লেখক মিঠুন রাকসাম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ও সাংবাদিক অনিক রায়, আইনজীবী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সায়ক চাকমা।

পাভেল পার্থ বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংবিধান দর্শন বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল, যেখানে সমাজের সব শ্রেণি, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে। লারমা সংবিধানের মাধ্যমে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন, যা শ্রেণি এবং জাতিগত বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সবার স্বার্থকে সুরক্ষা দেবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় লারমা রাষ্ট্রের জাতীয়তা নির্ধারণে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের ওপর একতরফা জোর দেওয়ার বিরোধিতা করেন, কারণ এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র পরিচয়কে অস্বীকার করে। লারমা বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রীয় পরিচয় অবশ্যই সব জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দেওয়া হবে। তিনি উন্নয়ন ও ভূমি অধিকার নিয়ে বিনাশী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর তীব্র সমালোচনা করেন, যা আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জুমচাষ ও কৃষির টিকে থাকার ওপর হুমকি তৈরি করেছিল।

তিনি বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গি তার রাজনৈতিক কাজেও প্রতিফলিত হয়েছিল। তিনি তার সংগঠনের কর্মীদের পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং কৃষি, জুমচাষ ও ভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষের স্বার্থ রক্ষার লড়াইকে রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখতেন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লারমার চিন্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজকের প্রজন্ম যে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনের দাবি তুলেছে- যেখানে ‘হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশ’- এই চেতনা লারমার দার্শনিকতা ও সাম্যবাদের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। নতুন প্রজন্মের গ্রাফিতি ও রাজনৈতিক চেতনায় লারমার চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়, যেখানে পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব এবং উন্নয়নের নামে নিপীড়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। লারমার চিন্তার কেন্দ্রে ছিল রাষ্ট্রের এমন এক রূপান্তর, যেখানে কৃষি, শ্রমজীবী মানুষ এবং প্রান্তিক সম্প্রদায় সবাই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করবে।

দীপায়ন খীসা শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা যে আওয়ামী ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়ছি, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সেই ১৯৭২ সালে গণপরিষদ বিতর্কে একাই লড়াই করেছিলেন। তিনি কাঠামোগতভাবে সংবিধানকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি বহুত্ববাদের চিন্তা করেছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন দীপায়ন খীসা।

অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে সরল বানানোর ডিসকোর্সের মাধ্যমে নির্যাতন করা হচ্ছে। দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্ধারণে আলোচনা করা উচিত। রাষ্ট্র যে বাঙালি আধিপত্যবাদের ভিত্তিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে মূল্যায়ন করে সেই একই আধিপত্যবাদ পাহাড়ে চলতে পারে না। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ সালের যে বিষয়গুলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ক্ষুণ্ন করে সেগুলোকে সংস্কার করা দরকার। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যে সব বিষয় সাংঘর্ষিক সেগুলোর বিষয়েও কাজ করা জরুরি।

অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন বলেন, এমএন লারমাই প্রথম, যিনি জাতি এবং জাতীয়তার ব্যপারে প্রশ্ন করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে উপজাতী শব্দটির ব্যবহার একটি উপনিবেশিক মনঃস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ। এ সময়ে এসে এ ধরনের চিন্তা করা সঠিক নয়। ৯০ দশকের পর থেকে আদিবাসী ডিসকোর্সটি শুরু হয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আজকের বিষয়গুলোকে সংস্কার করতে হবে। তিনি তরুণ প্রজন্মকে দেশের সব শ্রেণির মানুষকে প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে আমরা সবসময় উপনিবেশিক চশমা দিয়ে দেখি। তিনি এ চশমাটি খুলে আদিবাসীরাও যে দেশের গর্বিত নাগরিক, তাদের যে অধিকার রয়েছে সে অধিকার সুরক্ষা করতে হবে। আজকের নতুন বাংলাদেশে আমরা এথনিসিটি নির্ধারণ করার সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের সমতল অঞ্চলেও যে সব আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে।

এহসান মাহমুদ বলেন, এমএন লারমার ধারণাকে বাঙালির চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে। বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকলে এমএন লারমাকে আঞ্চলিক নেতা হিসেবে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, যে শ্রেণি দ্বারা দেশের প্রথম সংবিধান রচনা করা হয়েছে সেই উচ্চবিত্ত শ্রেণিই বর্তমান সংস্কার কমিশনকে প্রতিনিধিত্ব করছে। কারণ সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। সামান্তা শারমিন বলেন, আমরা যে এক দফার ভিত্তিতে আন্দোলন করেছিলাম সেটি এখনো সফল হয়নি। তবে এ আন্দোলনের ফলে নতুন করে প্রশ্ন করার সুযোগ এসেছে, আলাপ-আলোচনার সুযোগ এসেছে। এ আলাপ-আলোচনার পরিসর যেন শেষ না হয়। আমাদের সংবিধান একটি অভিশপ্ত সংবিধানে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নাগরিক মর্যাদাকে বেশ গুরুত্বসহকারে দেখা হয় কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান এটি করতে ব্যর্থ। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংবিধানকে জনমুখী করতে হবে। নতুন সংবিধানে নাগরিক মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সব শ্রেণির মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

তিনি বলেন, এমএন লারমা সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। যৌথতা এবং শান্তি এটিই হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত্তি।

আইনজীবী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সায়ক চাকমা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী একটি বড় স্টেকহোল্ডার। আমরা একটি ইতিহাসের সন্ধিঃক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। একটি বড় রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে পরাভূত করে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে সে সংস্কারে আদিবাসীদের ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব রাখতে হবে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম যে সমাজব্যবস্থা ছিল সে সমাজব্যবস্থা ভেঙে বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা সংস্কারে হাত দিয়েছে- সে সংস্কারে আদিবাসী প্রতিনিধি নিশ্চিত না করলে বৈষম্যহীন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারী বিশ্বকাপের প্রাইজমানি ঘোষণা, কত পাবে চ্যাম্পিয়ন দল

আকস্মিক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনে আইন উপদেষ্টা

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পরিবর্তন

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে প্রাণহানি বেড়ে ৬ শতাধিক, আহত ১৫০০

এবার ৬ দফা ঘোষণা বাকৃবি শিক্ষার্থীদের

সাংহাই সম্মেলনে শি, মোদি ও পুতিনের খোশগল্প, কী কথা হলো?

২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাগরে লঘুচাপ, সারা দেশে ভারী বৃষ্টির আভাস 

দ্বিতীয় ম্যাচে যে একাদশ নিয়ে মাঠে নামতে পারে বাংলাদেশ

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎ

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশেষ গেট চালু

১০

সাত বীরশ্রেষ্ঠর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৭ দফা ইশতেহার ডাকসু প্রার্থীর

১১

আরও সাত দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা

১২

আ.লীগ আমলের লুটপাটের খেসারত দিচ্ছেন ৫ ব্যাংকের গ্রাহকরা

১৩

খালি পেটে দুধ চা খাচ্ছেন? জেনে নিন পুষ্টিবিদের সতর্কবার্তা

১৪

ইরানের হামলায় ১২ দিনে ধ্বংস হলো ইসরায়েলের ২১টি স্থাপনা

১৫

ভারতে বসে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করলেন আ.লীগ নেতা হানিফ

১৬

দিল্লিতে হাসিনার বাড়ির পাশেই সিআরআইয়ের কার্যালয়, মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য

১৭

স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ এক হলে কী সমস্যা হয়? যা বলছেন চিকিৎসক

১৮

চার মাসের মধ্যে স্বর্ণের দামে রেকর্ড, পিছিয়ে নেই রুপাও

১৯

বিএনপিকে শুভেচ্ছা জানালেন সারজিস

২০
X