বর্ষার কাক ডাকা ভোর থেকে শ্রমজীবী মানুষের হাঁকডাক। চোখেমুখে তাদের অসহায়ত্বের ছাপ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র শ্রমজীবী এসব মানুষ এসেছে কুমিল্লা শহরের শ্রম বেচাকেনার হাটে। স্থানীয় ভাষায় কেউ তাদের বলে দাওয়ালী, কেউ বলে মুনি, কেউ বলে কামলা আর ভদ্র ভাষায় অনেকে ডাকেন কৃষিশ্রমিক বলে।
কারও হাতে কর্নি-কোদাল-টুকরি, আবার কারও হাতে বাঁশের ঝুড়ি-কাস্তে। তবে শ্রমিকের তুলনায় ক্রেতা কম থাকায় কাজ না পেয়ে শ্রম বিক্রি করতে আসা এসব লোকজন আছেন বিপাকে।
প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত কান্দিরপাড়, শাসনগাছা, ক্যান্টনমেন্ট, আলেখারচর,পদুয়ার বাজারসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় এ হাট বসে। ভোরের আলো ফুটতেই জমে ওঠে শ্রমিকের এ হাট। শ্রম বিক্রি করতে এ হাটে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন নানা বয়সের শ্রমজীবী মানুষ। কয়েক মাস যাবত নগরীর কান্দিরপাড় এলাকায় শ্রমিকের এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। এতে অনেক শ্রমিক কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
সরেজমিনে এ হাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নানা বয়সের শ্রমজীবী মানুষ। তাদের হাতে হাতে ব্যাগ, কাস্তে ও ভার, কর্নি, টুকরি আবার কেউ কেউ খালি হাতেই কাজের অপেক্ষা করছেন। হাটে ওঠা শ্রমিকরা কেউই কুমিল্লার স্থানীয় বাসিন্দা নন। তারা রংপুর, নীলফামারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন এ হাটে।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ধনারপাড়া থেকে হাটে এসেছেন রাজমিস্ত্রি আতাউর রহমান। কুমিল্লা নগরীর টমছম ব্রিজ এলাকায় এক রুমের বাসা নিয়ে থাকেন একই এলাকার তিনজন শ্রমজীবী। প্রতিদিন ভোরে কাজের খোঁজে এই হাটে আসেন। নিজের শ্রম বিক্রি করতে রোববার ক্রেতার আশায় বসেছিলেন হাটে। কিন্তু সকাল আটটা বাজলেও কেউ কাজের জন্য তাকে নেননি।
তিনি জানান, পাঁচ সদস্যের সংসার চলে তার উপার্জনে। তিন-চার মাস ধরেই শ্রমের বাজার মন্দা। ফলে তার সংসার প্রায় অচল।
তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে ১১০ টাকায় দিনমজুরি করতাম। সংসার খরচের পরও ৪০-৫০ টাকা বাঁচত। এখন মজুরি ৮০০ টাকা। তা দিয়ে চাল-ডাল, সবজি কিনতেই ফুরিয়ে যায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা শ্রমিক জুয়েল মিয়া বলেন, আমাদের এলাকায় কাজ কম। যে কাজ আছে তা দিয়ে সংসার ঠিক মতো চলে না। তাই এই এলাকায় কাজের সন্ধানে এসেছি। কিছু দিন কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে আবার ফিরে যাব বাড়ি। প্রতি বছরই আমরা কয়েকজন মিলে এই এলাকায় কাজের খোঁজে আসি। আমাদের এলাকার তুলনায় এ এলাকায় কাজ বেশি। এ জন্যই আমরা আমাদের এলাকার কাজ শেষে অনেকে মিলে এখানে কাজ করতে আসি। তবে অন্য বছরের তুলনায় এবার কাজের চাহিদা কম। ভোর বেলায় এসে ক্রেতার আশায় বসে থেকে এখনো কোনো কাজ জোটেনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশির দশক থেকে কুমিল্লায় প্রতিদিন ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করানোর জন্য শ্রমিক বেচাকেনা হয়ে আসছে। প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে আসা শ্রমিকরা এই বাজারে কাজের খোঁজে আসেন। স্থানীয় গৃহস্থরাও এই সুবাদে সহজভাবেই শ্রমিক পেয়ে যাচ্ছে। এতে শ্রমিক ও গৃহস্থ উভয়ের জন্য সুবিধা হয়েছে। তবে বহু বছর পর এবার শ্রম বিক্রির হাটে শ্রমিকদের হাহাকার দেখা যাচ্ছে।
বাজারে শ্রমিক নিতে আসা সাইফুল্লাহ তারেক অতুল বলেন, আমাদের এলাকার স্থানীয় শ্রমিক এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। দূর-দূরান্ত থেকে আসা শ্রমিকরাই আমাদের ভরসা।
তিনি বলেন, আগে কম টাকায় এই হাটে শ্রমিক পাওয়া যেত। এখন ৮০০ থেকে ১০০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। তাই ছোটখাটো কাজের জন্য শ্রমিক নেওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। আজ কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য এই হাটে এসেছি শ্রমিক নিতে।
মন্তব্য করুন