পেশায় ট্রাকচালক হোসেন আলী। ট্রাকভর্তি মালামাল নিয়ে গেছেন হবিগঞ্জ জেলার শাববাজপুর। ট্রাক থেকে মাল নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। পরে রাত ২টার দিকে মোবাইলে খবর পান তার বাবা, মা ও ভাই-বোন মাটিচাপা পড়েছেন।
খবর পাওয়ার পরই বাড়িতে ফেরেন হোসেন আলী। সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন মাটিচাপা থেকে একে একে উদ্ধার করা হয়েছে মা রহিমা বেগম, বোন সামিয়া খাতুন ও ভাই আব্বাস উদ্দিনের মরদেহ। পরে চোখের সামনেই মাটি সরিয়ে উদ্ধার করা হয় বাবা রিয়াজ উদ্দিনের নিথর দেহটি।
চোখের সামনে চারটি নিথর দেহ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন হোসেন আলী। কীভাবে কি হয়ে গেল, বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। কারণ ৩৫ বছর ধরে টিলার পাশে বসবাস করা হোসেন আলীর পরিবারের চার সদস্য মুহূর্তে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল।
এর আগে রোববার (০১ জুন) ভোর ৪টার দিকে সিলেটের গোলাপগঞ্জে ৭ নম্বর লক্ষণাবন্দ বখতিয়ার ঘাটের আলভিনা আনারস বাগানের পাশের একটি টিলা ধসের এ ঘটনা ঘটে। টানা বৃষ্টিতে টিলা ধসে ঘরের ভেতরে স্বামী-স্ত্রী ও শিশুসহ একই পরিবারের চারজন মাটিচাপা পড়েন। পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস, সোনাবাহিনী, পুলিশ। পরে বাদ আসর জানাজা শেষে বখতিয়ারঘাট গ্রামের করবস্থানে দাফন করা হয়।
মারা যাওয়া চারজন হলেন- গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের বখতিয়ারঘাট এলাকার রিয়াজ উদ্দিন (৫০), সামিয়া খাতুন (১৫), আব্বাস উদ্দিন (১৩) ও রহিমা বেগম।
রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে হোসেন আলী কালবেলাকে বলেন, আমাদের পরিবার ৩৫ বছর ধরে এ এলাকায় বসবাস করছেন। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। রাতে টিলা ধসে টিলার গাছ, মাটি ও ঘরের দেওয়াল আমার আব্বা, আম্মা ও ভাই-বোনের উপরে পড়ে। এ সময় তারা ঘুমে ছিলেন। আমাদের পরিবার আগে টিলার উপরে ছিল; আমরা সাত বছর আগে নিচে ঘর বানিয়েছিলাম। যখন টিলার আরও উপরে ছিলাম তখন এ রকম কোনো কিছু হয়নি, এখন কেন হলো বুঝতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, আমার আম্মা আর ছোট বোন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। বারবার আব্বার কথা বলছেন আর কান্না করছে। তবে তারা শারীরিকভাবে কোনো আঘাত পায়নি। আল্লাহ তাদের বাঁচিয়েছেন, না হয় তাদেরও পেতাম না। কারণ পাশের রুমেই তারা ঘুমিয়েছিল। চোখের সামনে পরিবারের চারজনকে হারিয়ে ফেললাম।
হোসেন আলীর চাচি ফাতেমা বেগম বলেন, আমার ভাসুর রিয়াজ উদ্দিন দিনমজুর ছিলেন। তিনি দুই বিয়ে করেছিলেন। ঘটনার সময় তিনি বসতঘরের দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। পাশের রুমে ছিল অন্য স্ত্রীসহ সন্তানরা। শনিবার রাত দেড়টার দিকে প্রবল বৃষ্টিতে টিলার মাটি, চালের টিন ও দেওয়াল ধসে পড়লে ভেতরে থাকা চারজন চাপা পড়েন। চিৎকার শুনে স্থানীয়রা মাটি সরানোর চেষ্টা করেন। তখন টিলা থেকে মাটি নামার কারণে আমরা কিছু করতে পারছিলাম না। পরে ফায়ার সার্ভিস, সোনাবাহিনী, পুলিশ ও উপজেলার লোকেরা এসে মরদেহগুলো উদ্ধার করে আনেন।
তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনা যখন ঘটে গেছে, তখন আর কি করার আছে। তাই ময়নাতদন্ত না করেই আমরা মরদেহ দাফন করেছি। মেয়েকে বিয়ে ও ছেলেকে বিয়ে করানোর কথা ছিল তাদের। তার আগেই তারা চলে গেলেন। বিষয়টি মেনে নেওয়ার মতো না। একসঙ্গে চারটি প্রাণ চলে গেল।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ বলেন, টিলা ধসে মাটিচাপায় একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। তাদের পরিবারে ছয়জন ছিলেন। ভাগ্যক্রমে দুজন বেঁচে গেছেন। দাফনের সম্পূর্ণ খরচ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। টিলাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সতর্কবার্তা বেশ আগে থেকে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও সতর্ক করেছিলেন। আমরা এ কার্যক্রম শীত মৌসুমে শুরু করেছিলাম। মানুষকে সচেতন করতে এ এলাকায় মাইকিং করা হয়েছিল। এখন থেকে যারা নিরাপদ স্থানে সরে না যাবেন তাদের আমরা সরিয়ে নেব।
মন্তব্য করুন