উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ও বাণিজ্যিক শহর দেড়শ বছরের পুরোনো বগুড়া পৌরসভা শিগগিরই সিটি করপোরেশনে উন্নীত হচ্ছে। প্রস্তাবিত এ সিটির সীমানায় সদর ও শাজাহানপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন যুক্ত করার চিন্তা চলছে বলে জানা গেছে। শিগগিরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে সিটি করপোরেশন ঘোষণার জন্য গেজেট প্রকাশের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বগুড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক (উপসচিব) মাসুম আলী বেগ বলেছেন, গণশুনানিতে আসা মতামত ও প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দ্রুত আমরা সুপারিশ পাঠাচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া পৌরসভা এলাকার আনুমানিক জনসংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। ২০২৩ সালের জাতীয় ভোটার তালিকা অনুসারে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার। সিটি করপোরেশন ঘোষণার জন্য স্থানীয় সরকার বিধিমালা অনুযায়ী ন্যূনতম জনসংখ্যা হতে হয় ৫ লাখ, যা বগুড়া পৌরসভা এককভাবেই পূরণ করে ফেলেছে।
প্রস্তাবনা অনুসারে পৌরসভার সীমানা ছাড়িয়ে শহরতলির যেসব ইউনিয়ন বর্ধিত মহানগরীর অংশ হতে পারে সেগুলো হলো— সদর উপজেলার সাবগ্রাম, রাজাপুর, নিশিন্দারা, এরুলিয়া, ফাঁপোড় ও শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়ন। এসব এলাকার জনসংখ্যা যুক্ত করলে সম্ভাব্য জনসংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৮ লাখ থেকে ৯ লাখে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মহানগরীর জন্য আদর্শ জনসংখ্যা।
বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বগুড়া জেলার মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ২ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার। এটি জাতীয় গড় মাথাপিছু আয়ের (২ হাজার ৫৫০ ডলার) চেয়েও কিছুটা বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি সিটি করপোরেশনের মর্যাদার অন্যতম যোগ্যতা।
বগুড়া পৌরসভার নিজস্ব রাজস্ব আয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল প্রায় ৩২ কোটি টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সে আয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪২ কোটি টাকা। এই পরিমাণ আয় অনেক জেলা শহরের পৌরসভার চেয়ে তিন গুণ বেশি এবং জাতীয় গড় রাজস্ব আয় তুলনায় বহুগুণে এগিয়ে।
জানা গেছে, বগুড়া পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলতি বছরের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এরপর নির্ধারিত বিধিমালার আলোকে একে একে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ধাপ অতিক্রম করেছে জেলা প্রশাসন। বর্তমানে প্রক্রিয়াটি পৌঁছেছে চূড়ান্ত সুপারিশপত্র পাঠানোর পর্যায়ে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
সিটি করপোরেশন ঘোষণার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজ গত ২৭ এপ্রিল গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) প্রতিষ্ঠা বিধিমালা, ২০১০ অনুযায়ী, এতে বলা হয়, ৩০ দিনের মধ্যে কেউ আপত্তি বা মতামত দিতে চাইলে, তা লিখিতভাবে জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে।
গণবিজ্ঞপ্তির পর নির্ধারিত সময়সীমা শেষে মে মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় গণশুনানি। এতে ২০ জনের বেশি ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে মতামত ও সুপারিশ পেশ করেন। এসব মতামতের ভিত্তিতে অঞ্চল সম্প্রসারণ, নাগরিক সেবা কাঠামো এবং এলাকাভিত্তিক সংযুক্তিবিষয়ক সুপারিশ নেওয়া হয়।
গণশুনানির পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখা সব আবেদন যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সুপারিশপত্র তৈরি করেছে। এতে জনগণের মতামত, সিটি করপোরেশন ঘোষণার যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ফাঁপোড়-আশেকপুর শিল্পাঞ্চলকে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উন্নত নীতিমালা, উন্নত অবকাঠামো এবং সহজতর সেবা নিশ্চিত করা হবে। এটি বিশেষ করে শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে। এ ছাড়া শহরের সীমা বাড়ানো হলে, সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিকদের জন্য উন্নত নাগরিক সেবা—যেমন পানি সরবরাহ, সড়ক উন্নয়ন, ডাস্টবিন পরিষ্কার, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেবা নিশ্চিত করা যাবে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, শহরের উন্নয়ন কেবল পৌরসভার সীমানা বাড়ানোতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আরও বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। সিটি করপোরেশন হলে নতুন শিল্প ও বাণিজ্যিক সুযোগ তৈরি হবে, যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।
বগুড়া নগর উন্নয়ন ফোরামের সদস্য সচিব অধ্যাপক আ স মালেক বলেন, আলোচনায় আমরা বলেছি শুধু পৌর এলাকা নয়, সাবগ্রাম, রাজাপুর, নিশিন্দারা, এরুলিয়া, ফাঁপোড় ও আশেকপুর ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ শহরের বাস্তব সম্প্রসারণ এ এলাকাগুলোর মধ্যেই। নতুন অঞ্চল অন্তর্ভুক্তির ফলে রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্থানীয় কর, সেবা চার্জ ও অন্যান্য বিপণন করের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন অতিরিক্ত আয় করবে।
সুশসানের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) জেলা সম্পাদক কে জি এম ফারুক বলেন, প্রশাসনের প্রস্তাবিত সীমানা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বগুড়া সিটি করপোরেশন গঠনের প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন শহরের গতি ও পরিচিতি বৃদ্ধি পাবে, তেমনি নাগরিকদের জন্য উন্নত সেবা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং শহরকে একটি পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগও সৃষ্টি হবে। এতে করে বাজেট বাস্তবায়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও কর ব্যবস্থাপনায় পৌরসভার তুলনায় অধিক ক্ষমতা থাকবে। নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক কন্ট্রোল, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী রোড, মার্কেট, আবাসন ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণ এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগ সহজ হবে এই সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন হলে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজ বলেন, সিটি করপোরেশন হওয়ার ক্ষেত্রে বগুড়া পৌরসভা সব শর্ত পূরণ করেছে। শিগগিরই গেজেট প্রকাশের জন্য সুপারিশ পাঠানো হবে।
মন্তব্য করুন