

রংপুরের তারাগঞ্জে নিজ বাড়ি থেকে এক মুক্তিযোদ্ধা ও তার স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) সকালে উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের উত্তর রহিমাপুর এলাকায় ওই বাড়ি থেকে পুলিশ লাশ দুটি উদ্ধার করে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় (৭৫) ও তার স্ত্রী সুবর্ণা রায় (৬০)।
জানা গেছে, রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে প্রতিবেশীরা মই বেয়ে নিহত দম্পতির বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। প্রধান দরজার চাবি নিয়ে দরজা খোলার পর ডাইনিংরুমে যোগেশ চন্দ্র রায়ের ও রান্নাঘরে সুবর্ণা রায়ের রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তারা। পরে তারা পুলিশকে খবর দেন।
স্থানীয়রা জানান, মুক্তিযোদ্ধা যোগেশচন্দ্র রায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে শোভেন চন্দ্র রায় জয়পুরহাটে এবং ছোট ছেলে রাজেশ খান্না চন্দ্র রায় ঢাকায় পুলিশে চাকরি করেন। সন্তানরা বাইরে কর্মরত থাকায় তারা স্বামী-স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকতেন।
বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক দীপক চন্দ্র রায় জানান, তিনি যোগেশ চন্দ্র রায়ের বাড়ি দেখাশোনা করেন। তিনি প্রতিদিন সকালে কাজ করতে সেখানে যান। আজ সকাল ৭টা পর্যন্ত ঘর থেকে কেউ বের না হওয়ায় সন্দেহ হয়।
দীপক চন্দ্র রায় বলেন, বাইরে থেকে ডাকাডাকি করেও কোনো শব্দ না পেয়ে আশপাশের লোকজনকে ডাকি। এরপর মই বেয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি ঘরে কেউ নেই। পরে ডাইনিং রুমের দরজা খুলে দেখি দাদুর রক্তাক্ত লাশ আর রান্না ঘরে দিদার লাশ পড়ে আছে।
ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে তদন্ত শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
পরে ঘটনাস্থলে যান রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সুধাংশু রায়, জেলা পুলিশ সুপার মারুফাত হুসাইন, র্যাব-১৩ এর সহকারী পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোনাব্বর হোসেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আলী হোসেন।
ক্রাইমসিনে আলামত সংগ্রহ ও সুরতহাল প্রতিবেদন সম্পন্ন করার পর দুপুর তিনটার দিকে নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
পরে সেখানে এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জেলা পুলিশ সুপার মারুফাত হুসাইন। তিনি জানান, যোগেশ চন্দ্র রায়ের দুই ছেলের একজন পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও আরেকজন র্যাবে কর্মরত রয়েছেন। এজন্য তারা স্বামী-স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী থাকতেন। শনিবার রাত ৯টা ২২ মিনিটে মোবাইল ফোনে তার ছোট ছেলের সঙ্গে যোগেশ চন্দ্রের সবশেষ কথা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, রোববার সকালে গ্রামের বাসিন্দা দীপক রায় তাদের বাড়িতে কাজ করতে এসে গেটের বাইরে থেকে অনেক ডাকাডাকি করলেও তারা সাড়া দেননি। পরে তাদের শোবার ঘরের পেছন দিক দিয়েও ডাকাডাকি করা হয়, তবে সেখান থেকেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে আরেকজনের সহযোগিতায় গেট টপকে ভেতরে গিয়ে দেখতে পান যোগেশ চন্দ্র রায় ডাইনিং রুমে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন এবং তার স্ত্রীর সুবর্ণা রান্নাঘরের বেসিনের পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পরে তারা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে চলে আসে।
তিনি বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। পরে সুরতহালও সম্পন্ন করা হয়েছে। অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। খুব কম সময়ের মধ্যে এ হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, নিহত সুবর্ণা রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছিলেন, তার মানে তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন না। আর এ ঘটনা সকালে হওয়ার মতোও না, কারণ রক্তটা আগের সেটা বোঝা যাচ্ছে। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১১টার ভেতরে এ ঘটনা ঘটতে পারে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে এ বিষয়ে স্পষ্ট জানা যাবে।
আঘাতের ধরন সম্পর্কে তিনি বলেন, যোগেশ চন্দ্র রায়ের মাথার পেছনের দিকে একটি কোপের চিহ্ন আছে এবং তার স্ত্রী সুবর্ণার কপাল বরাবর একটা কোপের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। ধারণা করছি চাইনিজ কুড়াল অথবা রামদা দিয়ে আঘাত করা হতে পারে। তবে আমাদের মনে হয় চাইনিজ কুড়ালই হতে পারে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার পরেই এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
চুরি ডাকাতির উদ্দেশ্যে এ খুনের ঘটনা কিনা জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, একটা আলমারি আমরা ভাঙা পেয়েছি কিন্তু চুরি এবং ডাকাতির যে লক্ষণ ওরকম আমার কাছে মনে হয়নি। আলমারির ভেতরে দুইটি ড্রয়ারের মধ্যে একটি ভাঙা, ওখানে কাগজপত্র আছে দেখলাম। পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি যে টাকা পয়সা বা গহনা কেমন আছে। তখন তারা জানিয়েছে যে মায়ের কানের দুল এবং নাকের ফুল এরকম খুব স্বাভাবিক ছিল। তাদের ছেলের স্ত্রী জানিয়েছেন যেহেতু বৃদ্ধ পিতা-মাতা এখানে থাকে সেহেতু টাকা পয়সা এখানে রাখা হয় না।
তারাগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আলী হোসেন বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
মন্তব্য করুন