৭২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে থানায় আটকে রেখে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া দুই আসামিকে নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে। শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
গত মঙ্গলবার (৬ জুন) ভুক্তভোগীর বড় ভাই আবু জাফর ঠান্ডু জেলা পুলিশ সুপার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
পুলিশ, ভুক্তভোগী ও অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ মে দ্রুত বিচার আইনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। মামলায় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা আহম্মেদ চোকদার কান্দি এলাকার সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় ২৯ মে তিনজন আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হন।
জামিনে আসার পর ৩০ মে রাতে সাদ্দাম, বকুলসহ আসামি সাইদুল শেখ, আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকা কেরানীগঞ্জ সাদ্দামের বন্ধু আলমগীর চোকদার বাসায় যান। ওই দিন রাতে তথ্য পেয়ে সেই বাসায় হাজির হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির, ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারীসহ ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য। সাদ্দাম তাদের জামিনের কাগজ দেখানো মাত্র ছিঁড়ে ফেলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল। পরে সাদ্দাম ও বকুলকে লাথি, কিল-ঘুসি, চড়-থাপ্পড়সহ পুলিশের লাঠি (ডান্ডা), কাঠ, হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধর করতে থাকে। একপর্যায়ে প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলে। নির্যাতন চলে রাত ১টা থেকে পরের দিন ৩১ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত।
কিছুক্ষণ পর ওই চারজনকে গামছা ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর নিচে আনা হয়। পরে সাদ্দাম-বকুল ও সাইদুল-আনোয়ারকে দুই স্থানে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি সাদ্দাম-বকুলকে বলেন, সাইদুল-আনোয়ারকে ক্রসফায়ার দিয়ে দিয়েছি। তোরা ৭২ লাখ টাকা দিবি, তা না হলে তোদেরও ক্রসফায়ার করা হবে। এভাবে সারা দিন রেখে রাতে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় এনে ৭২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে বেত ও কাঠ, কোদালের বাট, লাঠি দিয়ে আবার বেধড়ক মারতে থাকে সাদ্দাম ও বকুলকে। সারা রাত চলে এ নির্যাতন। এতেও তারা ক্ষান্ত হননি। টাকার জন্য বকুলের স্ত্রী সনজিদা, দুই বছরের সন্তান, বাবা রশিদ চোকদার, মা রমেলা ও চাচাতো ভাই আবু জাফর ঠান্ডুকে থানায় এনে সারা রাত আটকে রাখে এবং শারীরিক নির্যাতন করে তারা।
পরে তার আত্মীয়স্বজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসির কাছে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকার চেক দিলে নির্যাতন থেকে মুক্তি পায় তারা। এই দুই দিনে যন্ত্রণায় তারা চিৎকার করলেও তাদের খাবার ও ওষুধ দেয়নি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি। ১ জুন বিকেলে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনকে শরীয়তপুর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রিমান্ড নামঞ্জুর করেন। ৬ জুন বিকেলে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনই আদালত থেকে জামিন পান।
ছিনতাই মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২১ মে দুপুরে পদ্মা সেতু জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সোহাগ পরিবহন থেকে জাজিরা উপজেলার বাসিন্দা শাহীন আলম শেখ (২০) ও সেকেন্দার মাদবরকে (৫১) জোরপূর্বকভাবে নামিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা বিদেশি ডলার, মোবাইলসহ অন্য জিনিসপত্র নিয়ে যায় স্থানীয় সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ ১০-১১ জন। এ ঘটনায় ২৩ মে শাহীন আলম শেখ বাদী হয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় সাদ্দাম ও বকুলসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
ভুক্তভোগী সাদ্দাম চোকদার ও বকুল চোকদার বলেন, ‘আমাদের আটজনের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। সেই মামলায় আমরা তিনজন হাইকোর্ট থেকে জামিনে আসি। তবুও আমাদের থানায় ও একটি বাড়িতে আটকে ৭২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান। পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকার চেক দিই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসিকে।’
পদ্মা দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘ছিনতাই মামলার বাদীপক্ষ তাদের মারধর করেছে। এ বিষয়ে আমার সম্পৃক্ততা নেই। চেকের বিষয়েও আমার জানা নেই।’ নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনিরকে বারবার মোবাইল ফোনে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল হক বলেন, ‘গত ২৩ মে পদ্মা দক্ষিণ থানায় দ্রুত বিচার আইনে একটি মামলা হয়। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পরে কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে সত্যতা প্রমাণের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের রিপোর্ট তিন কার্যদিবসে জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে তাদের সম্পৃক্ততা পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মন্তব্য করুন