শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ লালমনিরহাটের অন্তঃসত্ত্বা সেই গৃহবধূ কল্পনা আক্তার মারা গেছেন। শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ভোর রাতে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে প্রাণপ্রদীপ নিভে যায় তার গর্ভের সন্তানেরও। পৃথিবীর আলো দেখা হলো না তার।
গত ১২ জানুয়ারি নিছক অসাবধানতায় কল্পনার কাপড়ে আগুন লাগে। এতে তার শরীরের হাঁটুর নিচ থেকে গলা পর্যন্ত ৬০ শতাংশ পুড়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে কল্পনাকে নেওয়া হয় লালমনিরহাট জেলা সদর হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রংপুরে নেওয়ার পরামর্শ দেন হাসপাতালের চিকিৎসক।
হাসপাতালের পক্ষ থেকে বলা হয়, লম্বা সময় ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কল্পনার চিকিৎসা করাতে হবে। তা না হলে তাকে ও তার গর্ভের সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। এ কারণে কল্পনাকে ঢাকার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তির পরামর্শ দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
কিন্তু এই চিকিৎসাকে ব্যয়বহুল ভেবে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রোগীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে রেখে আসেন কল্পনার স্বামী রুবেল। শুরু হয় কবিরাজি ঝাড়ফুঁকের মতো অপচিকিৎসা। কল্পনার অবস্থার আরও অবনতি হলে চিকিৎসা দিতে শুরু করেন গ্রামের এক পল্লীচিকিৎসক। তবে ভালো হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো বেড়ে যায় পুড়ে যাওয়া ক্ষতের যন্ত্রণা।
ধীরে ধীরে কল্পনার অবস্থার আরও অবনতি হয়। একপর্যায়ে ক্ষতস্থান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। এ সময় পরিচিত ও অপরিচিত যাকেই দেখেছেন, তার কাছেই গর্ভের সন্তান আর নিজেকে বাঁচানোর আকুতি জানান কল্পনা। কিন্তু স্বামী ও বাবাসহ পারিবারিক কুসংস্কারের মর্মান্তিক শিকার হন এই অন্তঃসত্ত্বা নারী।
কল্পনার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না তারা। এরপরই পাশে দাঁড়ায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। ‘টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না শীতে অগ্নিদগ্ধ কল্পনার’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে জাতীয় দৈনিক কালবেলা। যা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়। এগিয়ে আসেন দানশীল ব্যক্তিরাও। এ সময় অনেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে কল্পনাকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেন।
কিন্তু মেয়েকে ঢাকায় পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান কল্পনার একরোখা বাবা দরিদ্র কৃষক আব্দুল করিম। সাফ জানিয়ে দেন, ‘এখানেই চিকিৎসা হবে, হায়াত থাকলে মেয়ে বাঁচবে।’ অপচিকিৎসা, অযত্ন, অবহেলায় মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকে কল্পনা। একপর্যায়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
লালমনিরহাটের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. কাসেম আলী জানান, শরীরের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রোগীকে লম্বা সময় ধরে পরিচ্ছন্ন স্থানে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। সার্বক্ষণিক ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকলে এ ধরনের রোগীর উন্নতি হতে পারে।
গৃহবধূ কল্পনা লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের কোদালখাতা গ্রামের কৃষি শ্রমিক রুবেল মিয়ার স্ত্রী। দেড় বছর আগে কল্পনার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাদের। বাবা একই উপজেলার ফুলগাছ গ্রামের দরিদ্র কৃষক আব্দুল করিম। পাঁচ মাস আগে কল্পনার গর্ভে সন্তান আসে।
মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য প্রতিবেশী আব্দুল মালেক বলেন, ‘কল্পনা নিজের গর্ভের সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য। অনেকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা নানা কুসংস্কারের আশ্রয় নেয়। অপরিচ্ছন্ন স্থানে রেখে পল্লীচিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেয়। উন্নত চিকিৎসা দিলে হয়তো কল্পনাকে বাঁচানো যেত।’
মন্তব্য করুন