হিন্দু-মুসলমানের তীর্থস্থান বগুড়ার মহাস্থানগড়ে বসেছে সাধু-সন্ন্যাসী ও পুণ্যার্থীদের মিলনমেলা। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার মহাস্থানে বসে এ মেলা। একদিকে যেমন মুসলমানরা ইবাদত-বন্দেগিতে মেতে ওঠে, অপর দিকে আধ্যাত্মিক সাধনায় বিশ্বাসী সাধু-সন্ন্যাসী ও বাউল-সুফিরা জিকির ও মারফতী গান গেয়ে আসর জমান।
বিচিত্র সব পোশাকে সেজে সেসব আসরে বসেন সাধু-সন্ন্যাসীরা। তাদের কারও পরণে ছিল লোহার শিকল, কেউবা শরীরের সঙ্গে ঝোলানো একাধিক তরবারি।
মহাস্থানের এ মেলার বিষয়ে কথিত আছে, অত্যাচারী রাজা পরশুরামকে পরাজিত করে সুফী সাধক হয়রত শাহ সুলতান বলখীর (র.) পুণ্ড্রনগর তথা মহাস্থানগড় বিজয় এবং নিজের সম্ভ্রম ও ধর্ম রক্ষার জন্য পরশুরামের একমাত্র বোন শিলা দেবীর করতোয়া নদীতে আত্মবিসর্জনের দিন ছিল বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। তখন থেকেই পরবর্তী বছরগুলোতে এই দিনে মহাস্থানে উভয়ধর্মের মানুষ সমবেত হয় পুণ্য সঞ্চয়ের আশায়। কালক্রমে এটি হয়ে ওঠে সাধু-সন্যাসীদের মেলা।
মুসলমানরা ইবাদত-বন্দেগির জন্য শাহ সুলতান বলখী (র.) মাজারে অবস্থান নিলেও সাধু-সন্ন্যাসী ও বাউলরা অবস্থান নেন পার্শ্ববর্তী হজরত বোরহান উদ্দিন (র.) মাজার, পশ্চিম পাশের আমবাগান ও উত্তরপাশের আবাসিক এলাকা এবং পূর্ব-উত্তর পাশের শিলা দেবীর ঘটের মাঝে। এ ছাড়া মাজার সংলগ্ন পশ্চিম পাশের মাঠসহ পুরো মহাস্থান এলাকায় বসে মেলার পসরা।
হযরত বোরহান উদ্দিন (র.) এর মাজার ও পশ্চিমে মহাস্থান বাগানচত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে সামিয়ানা টাঙিয়ে মারফতি গানের আসর বসায় বাউল সাধকরা। এবার মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যেসব সাধু-সন্ন্যাসী সমবেত হয়েছেন, তারা প্রশাসনের কঠোরতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ফকির-বাউল ও সাধু-সন্ন্যাসীদের অভিযোগ, আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য তারা সিদ্ধি সেবন করেন ও মারফতি গানের আসর বসান। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন ও ধর্মের নামে কিছু উগ্রগোষ্ঠী তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করছে।
মাজার এলাকায় অর্থ ও খাবার পাওয়ার আশায় অগণিত ফকির-মিসকিনও সমবেত হন। তারা অর্থ প্রাপ্তির আশায় সারিগান গেয়ে মাজার চত্বর মুখরিত করে রাখেন। মহাস্থানে এসে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ও মনের আশা পূরণের জন্য অনেকেই মাজারের পশ্চিমপাশে থাকা প্রাচীন দুধ পাথরে দুধ ঢেলে দেন।
শুধু সাধু-সন্ন্যাসী আর পুণ্যার্থীরাই নয়, বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষও সমবেত হয়েছিলেন মহাস্থানের মেলায়। মাজারের পশ্চিম পাশের মাঠে হরেক রকম পণ্য নিয়ে বসা মেলা থেকে তারা গৃহস্থালীর নানা সামগ্রী কেনাকাটা করেন। এ ছাড়া মহাস্থানের ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত কটকটি বিক্রিও ছিল ব্যাপক।
মাজার চত্বরের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার ওসি আব্দুর রউফ বলেন, মেলা এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে পুরো মাজার ও আশপাশের এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
সাধু-সন্ন্যাসীদের আসরে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি মাজার কমিটির বিষয়। মেলা একদিনের হলেও সেখানে গত তিন দিন থেকেই লোকসমাগম শুরু হয়েছে। আগামী শনিবার পর্যন্ত সেখানে একইভাবে লোকজন থাকবে বলেও জানান ওসি।
মহাস্থান মাজারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান বলেন, বৈশাখের এ উৎসবটি কয়েক শত বছরের ঐতিহ্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধু-সন্ন্যাসীর পাশাপাশি ভক্ত-পুণ্যার্থীরা সমবেত হয়েছেন। মাজার কর্তৃপক্ষ তাদের শৃঙ্খলার মাঝে জিকির-প্রার্থনার ব্যবস্থা করেছে বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন