সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকে নীতিগত লক্ষ্যে পরিণত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি এমন একটি পদক্ষেপ যা ফিলিস্তিনিদের আড়ালে ফেলে দেবে এবং এর জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনকে উচ্চমূল্যও দিতে হতে পারে৷
জো বাইডেন প্রশাসন তথাকথিত সেই স্বাভাবিকীকরণ নীতিকে এখনই কেন অগ্রাধিকার দিচ্ছে, সেটি নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউট থিংকট্যাংকের একজন সিনিয়র ফেলো খালেদ এলগিন্ডি বলেন, বাইডেনের চিন্তাধারায় আরব-ইসরায়েল সংঘাতকে এমনভাবে দেখা হয় যেন ফিলিস্তিনিরা কোনো বিষয়ই নয়।
বাইডেন বিশ্বাস করেন, আরব-ইসরায়েল সংঘাতের মূল কারণ- আরব রাষ্ট্রগুলোর ইসরায়েলকে মেনে নিতে অক্ষমতা। দ্বন্দ্বটিকে যদি এভাবেই দেখা হয় তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে ঠিক মনে হবে।
নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস ফ্রিডম্যান গত সপ্তাহে বলেছিলেন, বাইডেন চেষ্টা করছেন যাতে ইসরায়েল ও সৌদি আরবকে একটি সুরক্ষিত চুক্তিতে আনা যায়। আর এই চুক্তিতে রাজি হওয়ার জন্য সৌদি আরবকে ন্যাটোর মতো নিরাপত্তা গ্যারান্টি এবং সৌদি আরবের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করতে সহায়তার অফার দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
ফ্রেডম্যান তার রিপোর্টে বলেছেন, আমেরিকার এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিদের সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। তবে এতে তাদের জন্য কিছু ছাড় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যেমন- ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বন্ধ করা এবং দখলকৃত পশ্চিম তীরকে কখনও ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত না করার প্রতিশ্রুতি।
'স্বাভাবিককরণ' বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
মার্কিন কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, তারা সৌদি-ইসরায়েল চুক্তি চাইছেন। তবে সেই চুক্তিতে ঠিক কী থাকবে, তারা তা প্রকাশ করেননি। ইসরায়েলি নেতারাও রিয়াদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা গোপন রাখেননি।
তবে সৌদি আরব অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে তার নীতি পরিবর্তন করেনি। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দুর্দশার একটি ‘ন্যায্য সমাধান’ খুঁজে বের করার নীতিতে একটি বড় অংশীদার সৌদি আরব। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়েও নীতিগত অবস্থান পরিবর্তন করেনি আরব এই দেশটি।
তারপরও সৌদি কর্মকর্তারা ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি।
গত বছর সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন, সৌদি আরব ইসরায়েলকে একটি ‘সম্ভাব্য মিত্র’ হিসেবে দেখে। তবে একইসঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তার সমস্যাগুলো সমাধান করা উচিত।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ গত জুনে তার মার্কিন সমকক্ষ অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আমরা বিশ্বাস করি, সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ এই অঞ্চলের স্বার্থেই প্রয়োজন, এটি সবার জন্য উল্লেখযোগ্য সুবিধা বয়ে আনবে।
একইসঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা ও ন্যায়বিচার দেওয়ার জন্য একটি দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথ খোঁজার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলেও উল্লেখ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে খুব কম আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের জন্য সুরক্ষা চুক্তি করতে সাহায্য করেছিল; যা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত। সে সময় ট্রাম্পের চাপে সুদানও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়।
এত কিছুর পরও ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে তার নীতির উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন করেনি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বর্ণবাদ বলে সমালোচনা করে আসছে।
ইসরায়েলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বর্তমান উগ্র ডানপন্থি সরকার যেভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি সম্প্রসারণ এবং সামরিক অভিযান জোরদার করেছে তাতে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক 'স্বাভাবিককরণ' চুক্তির পরও তার নীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যেতে চাইলেও তা খুব একটা সহজ হবে না। উদাহরণস্বরূপ, জনমত জরিপে দেখায় যে; সৌদি নাগরিকরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়াকে সমর্থন করে না।
তারপরও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এ যোগ দিয়েছে। যেসব চুক্তিকে ফিলিস্তিনিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘পিঠে ছুরিকাঘাত’ বলে অভিহিত করেছেন।
কয়েকটি আমেরিকান মিডিয়া আউটলেট রিপোর্ট করেছে, সৌদি আরব ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বার্থ আদায়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। তারা ওয়াশিংটন থেকে আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা গ্যারান্টি চেয়েছে বলে জানিয়েছে মিডিয়া আউটলেটগুলো।
মূল – আলী হারব, ভাষান্তর – মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন