প্রশ্নফাঁস নিয়ে গোটা দেশের মানুষের হতাশা আজ চরম পর্যায়ে। এখন শুধু এসএসসি, এইচএসসিই নয়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায়ও দীর্ঘদিন ধরে অবাধে প্রশ্নফাঁস হয়ে আসছে। শুধু ভর্তি পরীক্ষাই নয়, চাকরির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সব কারণে অনেক পরীক্ষা, এমনকি পরীক্ষার ফলও বাতিল করা হয়েছে। আবার অনেক প্রশ্নফাঁস, প্রশ্নের পরীক্ষার ফলও মেনে নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্নফাঁস নিয়ে ইতোপূর্বে সাংবাদিকরা অনেকবার শিক্ষা অধিদপ্তরে উচ্চপর্যায়ের প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের মুখোমুখী হলেও সেসময় অনেক কর্মকর্তাই প্রশ্নফাঁস নিছক মিডিয়ার বাড়াবাড়ি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। প্রশ্নফাঁস শুধু এ বছরই হচ্ছে তা নয়, গত প্রায় ৪০ বছর ধরে এ ঘটনা ঘটে আসছে।
আশির দশক থেকে ঢাকাভিত্তিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রায়ই ফাঁস হয়ে আসছে। ১৯৮০ সালে ঢাকা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় রসায়ন বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের কারণে ওই দিনের পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেওয়া হয়েছিল। তখন এ প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ছিল বেশির ভাগ ঢাকাভিত্তিক। প্রশ্নফাঁস করে অবৈধ টাকা কামানোর নেশায় নেমেছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। ফলে গত পাঁচ বছরে গ্রেপ্তার করা হয় এসব চক্রের প্রায় তিন শতাধিক সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পরিচালকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের একই অপরাধ করছে। বিচার কার্যক্রমের ধীরগতির সুবিধাও নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে র্যাব-১১ এর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আল আমিন রনি এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিল। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার আলোচিত নারী জনপ্রতিনিধি তার ভাইয়ের চাকরির জন্য প্রশ্নপত্র খুঁজতে গিয়ে প্রশ্ন বিক্রির সঙ্গে নিজেই জড়িয়ে পড়ে।
ইতোপূর্বে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার চক্রের কোনো কোনো সদস্য ২০১২ সাল থেকে ব্যাংক, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তরের অডিটর, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন হিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়, জ্বালানি অধিদপ্তর, সাধারণ বিমা করপোরেশনসহ অন্তত ১৮টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পুলিশের তদন্তে বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান নিখিল রঞ্জন ধরের নাম এলে বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। ২০২২ সালে গ্রেপ্তার হওয়া মাহমুদুল হাসান আজাদ, নাহিদ হাসান, আল আমিন সিদ্দিকীর আগেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৩, ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিল। তখন তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। এ কারণে তারা জামিনে ছিল, জামিনে বের হয়ে পুনরায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জঘন্য এই অপরাধের বিচার ধীরগতি ও শাস্তি একেবারেই ন্যূনতম হওয়ায় এসব চক্র উৎসাহিত হচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান আছে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের অপরাধের শাস্তির রায় হয়নি।
সবচেয়ে বেশি এবং ধারাবাহিকভাবে ফাঁস হয়ে আসছে গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন। সূত্র হতে জানা যায় ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে প্রশ্নফাঁস হয়েছে ১০ বার (ডেইলি স্টার, ১৩-৮-২৩)। সিআইডি তদন্তে প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত অনেকেই এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (৫০), ডা. সোহেলী জামান (৪০), ডা. মো. আবু রায়হান, ডা. জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮), ডা. মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮), ডা. জিল্লুর হাসান রনি (৩৭), ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২), গ্রেপ্তারকৃত জসীমের বড় ভাই জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩), জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫), শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)। চলতি বছরের ১৮ আগস্ট খুলনা ‘থ্রি ডক্টরস’ কোচিং সেন্টারের উপদেষ্টা ডা. ইউনুস উজ্জামান খান তারিমকে প্রশ্নফাঁস ইস্যুতে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করেছে ঢাকা সিআইডির একটি টিম।
প্রশ্নফাঁস একটি সভ্য জাতির জন্য কতটা কলঙ্ক বয়ে আনছে তা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের- ‘If you want to destroy a nation, first destroy it’s education’ - যদি তুমি একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে প্রথমেই ওই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করো। এ উক্তি থেকে বোঝা যায় এ যেন শত্রুপক্ষ বাঙালি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার এক মহোৎসবে মেতে উঠেছে।
দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই যেন আজ অনিয়ম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও দক্ষ শিক্ষক ছাড়াই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের বোর্ড সার্টিফিকেট পরীক্ষার খাতাও মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয় না। খাতা মূল্যায়নের সময় অদক্ষ পরীক্ষক তার আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে, এমনকি তার কাছে টিউশনিতে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের দিয়েও খাতা মূল্যায়ন করিয়ে থাকে। এ কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কম নম্বর পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভেঙে পড়ে।
এমনকি খাতা কল করে ত্রুটি পেলেও ওই অদক্ষ পরীক্ষকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তির বিধান আইনে রাখা হয়নি। কাজেই শিক্ষার্থীদের সমস্ত ভবিষ্যৎই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষা পদ্ধতিও পরিবর্তন করতে হবে। নৈর্ব্যত্তিক (৩০ নম্বর) রাখার কারণে স্বল্প সময়ে উত্তর দেবার সুবিধা থাকার জন্য প্রশ্নফাঁসকারীরা প্রশ্নফাঁসে উৎসাহিত হচ্ছে। এ পদ্ধতির পরিবর্তন করে যদি এমসিকিউ (নৈর্ব্যত্তিক) ৩০ নম্বরের পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত ৫ নম্বর করে ৬টি প্রশ্ন রাখা যায় তাহলে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে প্রশ্নফাঁস করেও এর কোনো সুফল না থাকার কারণে ফাঁসকারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করে দিবে। কোনো কারণে শিক্ষার্থীদের বোর্ড সার্টিফিকেট পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন না হলে, শিক্ষার্থীর অভিযোগ গুরুত্বের সাথে নিয়ে পরীক্ষার্থীর উপস্থিতিতে খাতা সঠিকভাবে যাচাইবাছাই করে মূল্যায়ন করতে হবে এবং মূল্যায়নের গাফিলতি থাকলে ওই অদক্ষ পরীক্ষকের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির বিধান রাখতে হবে।
প্রশ্নফাঁসের কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার বঞ্চিত, মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেডিকেলে সুযোগ না পাওয়ার কষ্টের দায়ভার নেবে কে? একজনকে খুনের দায়ে খুনির ফাঁসি হয়, কিন্তু প্রতিবছর হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ১৪ বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফসল, প্রশ্নফাঁসের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত নিকৃষ্ট চিকিৎসক নামধারী ও এদের সাথে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী সবাইকে আইনের আওতায় এনে ৩ থেকে ১০ বছর নয়, যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখলেই এ ধরনের সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
শিক্ষাকেই যেখানে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থাকে এত তাচ্ছিল্যভাবে দেখার কোনো সুযোগ নাই। কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে হলে, সরকার এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিককে শিক্ষা বিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রশ্নফাঁসকারী যে দলের বা যেই হোক না কেন, জাতির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তার কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে না পারলে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হবে। কাজেই জাতির এই দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন বলে দেশবাসী মনে করে।
এম এ কাদের : প্রাবন্ধিক ও নিবন্ধকার
মন্তব্য করুন