গাজায় ইসরায়েলের হামলার চার মাস শেষ হতে চলেছে। গাজার ২২ লাখ মানুষের বেশিরভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়ছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের ডানপন্থি সরকার গাজায় হয়তো তাদের হামলা বন্ধ করবে।
গাজায় সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে সেই উত্তাপ মধ্যপ্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গাজা এবং মধ্যপ্রাচ্যে আগামী তিন মাসে কী ঘটবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
গাজা এবং মধ্যপ্রাচ্যে আগামী তিন মাসে কী ঘটবে প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সেই প্রশ্নটি রাখা হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক শ্লোমো বেন-অমির কাছে। বেন-অমির বিশ্লেষণটি নিম্নে তুলে ধরা হলো-
শ্লোমো বেন-অমি:
লড়াইয়ে ছয় সপ্তাহের বিরতির জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছতে কাজ করছে আলোচনাকারীরা। এই সময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে হামাস অবশিষ্ট সমস্ত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। তারা সফল হলে এটি যুদ্ধের গতিপথে একটি বড় প্রভাব ফেলবে।
আলোচনার মূল কথা হলো যুদ্ধ এখনই শেষ হওয়া। হামাসের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতিতে আগেই সম্মতি জানানো হয়েছে। তবে ইসরায়েল তার নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। বিশেষ করে ইসরায়েল চায় হামাসের ‘বিলুপ্তি’। যদিও চুক্তিতে শুধু একটি যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে কোনো স্থায়ী শান্তিতে সম্মত হতে বলা হয়নি– তবুও এটি ধরে নেওয়া হয় যে, দীর্ঘ যুদ্ধবিরতি পুনরায় যুদ্ধ শুরু করার রাস্তাকে কঠিন করে তুলবে।
একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে স্বাভাবিকভাবেই সেটি উত্তর ফ্রন্টেও প্রযোজ্য হবে, যেখানে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে গুলি বিনিময় হচ্ছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে সীমান্ত এলাকা থেকে উচ্ছেদ হওয়া কিছু ইসরায়েলি বাসিন্দা তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে সক্ষম হবে। মার্কিন বিশেষ দূত আমোস হোচস্টেইনকে ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ সমাধানে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় তাহলে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ছয় সপ্তাহের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি রাজনৈতিক চুক্তিতে কাজ করার সুযোগ দেবে। যদি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) গাজা উপত্যকার প্রশাসনের দায়িত্ব নেয় এবং এলাকাটিকে সুরক্ষিত করতে একটি বহুজাতিক আরব বাহিনী মোতায়েন করা হয় তবে ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিষয়টিও আবার সামনে আসতে পারে।
আর যদি এমনটিই ঘটে তবে তা, চীন, ইরান (এবং এর প্রক্সি) এবং রাশিয়া সমন্বিত ’প্রতিরোধের অক্ষ’ মোকাবিলা করার জন্য মধ্যপন্থি আরব শাসন এবং ইসরায়েলসহ একটি পশ্চিমাপন্থি আঞ্চলিক জোট প্রতিষ্ঠার মার্কিন বৃহত্তর কৌশলগত উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
কিন্তু হিসাব-নিকাশ অন্যরকমও হতে পারে। নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক টিকে থাকা নির্ভর করছে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ওপর। স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির যে কোনো রাজনৈতিক চুক্তি নেতানিয়াহুকে সমর্থনকারী চরমপন্থিদের জোটকে ভেঙে দেবে। নেতানিয়াহু সেটা হতে দেবে কিনা সেটা এখন দেখার বিষয়।
যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এবং এই অঞ্চলকে সুরক্ষিত করতে যদি সত্যিকারের অগ্রগতি করতে হয়, তাহলে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়কেই তাদের রাজনৈতিক খুঁটি সাজাতে হবে।
ইসরায়েল যদি বিজয়ের দাবি না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এটি ইরাক যুদ্ধ শেষে সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল তেমনই একটি পরিস্থিতির জন্ম দেবে। হামাসের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নির্মূল করা হবে এবং এর কমান্ড চেইন ভেঙে দেওয়া হবে, যাতে সংগঠনটি আর সংগঠিত শক্তি হিসেবে কাজ করতে না পারে।
যদি হামাসের বিলুপ্তি ঘটে তবে হাজার হাজার হামাস যোদ্ধা ফিলিস্তিনি সমাজে পুনরায় ফিরে আসবে। সংঘর্ষ-পরবর্তী বিশৃঙ্খলায় কেউ কেউ অপরাধী দল গঠন করতে পারে, আবার কেউ কেউ উগ্র সালাফিস্ট দলে যোগ দিতে পারে। সবমিলে কারও জন্যই এই যুদ্ধ কোনো গৌরবময় বিজয় হবে না।
শ্লোমো বেন-অমি: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন