গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) করা মামলা থেকে সরে আসছে না দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, গাজায় জাতিগত নিধনের অভিযোগে করা এ মামলা যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরও অব্যাহত থাকবে।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) কেপটাউনের পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে রামাফোসা বলেন, ‘গাজায় যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এই শান্তি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে চলমান মামলার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।’
জাতিগত নিধনের অভিযোগে দায়ের মামলা
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করে। মামলায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন, বেসামরিক জনগণের ওপর ইচ্ছাকৃত হামলা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়।
২০২৪ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫০০ পৃষ্ঠার বিস্তারিত নথি আদালতে জমা দেয়। আইসিজের নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী, ইসরায়েলের পাল্টা যুক্তি জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২০২৬ সালের ১২ জানুয়ারি। মামলার মৌখিক শুনানি হতে পারে ২০২৭ সালে, আর চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হতে পারে ২০২৭ সালের শেষ ভাগে বা ২০২৮ সালের শুরুতে।
ইসরায়েলকে তিন দফা নির্দেশ, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি
এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ইসরায়েলকে তিনটি অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাতিগত নিধন বন্ধের আহ্বান, গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে বাধা না দেওয়া এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তবে ইসরায়েল এসব নির্দেশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও আশ্রয়কেন্দ্র।
ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি সম্ভব নয় : জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানিজ রামাফোসার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে এক্সে লিখেছেন, ‘ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা ছাড়া কোনো শান্তিই টেকসই নয়। ক্ষতিপূরণ ও দায়বদ্ধতার নিশ্চয়তা ছাড়া যুদ্ধবিরতি শুধু সময়ক্ষেপণ।’
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো স্যানশেজ, যিনি ইসরায়েলের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত, তিনি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি মানে দায়মুক্তি নয়। জাতিগত নিধনের জন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’
স্পেন ছাড়াও আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, কলম্বিয়া ও আরও কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলাকে সমর্থন জানিয়েছে বা সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছে।
‘দ্য হেগ গ্রুপ’-এর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা
বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকা “দ্য হেগ গ্রুপ” নামের একটি আন্তর্জাতিক জোটের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে গঠিত এই জোটটির লক্ষ্য হচ্ছে কূটনৈতিক, আইনি ও অর্থনৈতিক উপায়ে ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক মানবাধিকার সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় জাতিগত নিধনের অভিযোগ করে আসছে। জাতিসংঘ সমর্থিত একটি তদন্ত কমিশনও সম্প্রতি প্রতিবেদনে বলেছে, গাজায় ইসরায়েল ‘জাতিগত নিধন’ চালিয়েছে।
তবে ইসরায়েল এসব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে এবং বলেছে— গাজায় তাদের অভিযান ‘সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিরক্ষা উদ্যোগ’ ছাড়া আর কিছু নয়।
সূত্র : আলজাজিরা
মন্তব্য করুন