জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার জেরে তৈরি উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে বুধবার পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি শহরে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের এ অভিযানে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তত ৬টি শহর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ভারত কেন এ হামলা চালিয়েছে তা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
কোথায় কোথায় হামলা হয়েছে? পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী জানান, হামলা হয়েছে মূলত পাঞ্জাব প্রদেশের ৪টি শহরে এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ ও কোটলি এলাকায়।
সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতটি হয় আহমেদপুর শরকিয়ায়, যা বাহাওয়ালপুর শহরের কাছাকাছি। সেখানে একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে ক্ষেপণাস্ত্র পড়লে পাঁচজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে তিন বছর বয়সী এক কন্যাশিশুও রয়েছে।
এছাড়া মুরিদকে, সিয়ালকোটের একটি গ্রাম, ও শাকরগড় এলাকায় হামলা হয়। কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ ও কোটলিতে হামলায় দুটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে বলে পাকিস্তান দাবি করেছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া হামলার পরপরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান যে ‘উপযুক্ত জবাব দেওয়া হচ্ছে’। সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে ৩টি রাফায়েল জেট রয়েছে।
তবে এই দাবি ভারতের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নিজের আকাশসীমা থেকেই ছোড়া হয়েছে, অর্থাৎ কোনো ভারতীয় বিমান পাকিস্তানের ভেতরে প্রবেশ করেনি।
কেন এই হামলা? এই হামলার পেছনে রয়েছে ২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। কাশ্মীরের বিখ্যাত পর্যটনস্থান পেহেলগামের বৈসারণ উপত্যকায় বন্দুকধারীরা হামলা চালিয়ে ২৫ জন পর্যটক এবং এক স্থানীয় ট্টেকিং গাইডকে হত্যা করে।
সাক্ষাৎকার ও মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, হামলাকারীরা প্রথমে পুরুষদের মহিলাদের থেকে আলাদা করে এবং তারপর ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করে অমুসলিমদের গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় ভারতের জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে এই হামলার জন্য দায়ী করে এবং বলে এই হামলা দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামক একটি গোষ্ঠী করেছে, যারা পাকিস্তান থেকে পরিচালিত।
পাকিস্তান সরকার যদিও এই অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে এবং আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
নামের তাৎপর্য : ‘অপারেশন সিঁদুর’ ভারতের এই সামরিক অভিযানের নাম রাখা হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। এর প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। সিন্দুর হচ্ছে সেই লাল গুঁড়া, যা হিন্দু বিবাহিত নারীরা কপালে পরে থাকেন। ভারতের দাবি অনুযায়ী, পেহেলগামের হামলায় যেসব পুরুষ নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দু ছিলেন এবং তাদের স্ত্রীদের কপাল থেকে সিন্দুর মুছে গেছে—একটি প্রতীকী শোক ও প্রতিশোধের রূপক হিসেবেই এই নামকরণ।
কাশ্মীর ইস্যু : একটি পুরোনো যুদ্ধক্ষেত্র কাশ্মীরকে ঘিরেই ভারত-পাকিস্তানের অধিকাংশ সংঘর্ষের মূল রয়েছে। দুই দেশ ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ করেছে। বর্তমানে জম্মু ও কাশ্মীরের একাংশ ভারতের দখলে, একাংশ পাকিস্তানের এবং একটি অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে।
ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান নিয়মিতভাবে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। অপরদিকে, পাকিস্তান বলে তারা কেবল নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দেয়।
কূটনৈতিক পরিণতি ভারতের হামলার পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটেছে। ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যার ফলে পাকিস্তান ভয়াবহ পানি সংকটে পড়তে পারে। দুই দেশই একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে এবং ভিসা প্রদান ও সীমান্ত চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। আকাশপথও বন্ধ রয়েছে।
কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী দুই হাজারের বেশি মানুষকে আটক করেছে, যাদের অনেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ধরা হয়েছে।
মন্তব্য করুন