ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব-নৈরাজ্য বন্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। এরপরও কোথাও কোথাও নানা নেতিবাচক ঘটনায় দল ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পদধারী অনেক নেতার যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এরই মধ্যে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ সারা দেশে দলটির দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারের মতো কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনেককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জড়িতদের আইনের হাতে তুলে দেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দখলদারিত্ব-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে দলের এমন ‘জিরো টলারেন্স নীতি’র পরও অপকর্ম পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। দলের নজর এড়িয়ে কেউ কেউ গোপনে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে ‘নব্য বিএনপি’ ও দলের সুযোগসন্ধানী নেতাকর্মীদের দায়ী করছেন শীর্ষ নেতারা। তাদের দাবি, এরা বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব করছে। জড়িতরা বেশিরভাগই ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে তথ্য পেয়েছেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের দলের অবস্থান স্পষ্ট। কোনো দখলদারিত্ব-চাঁদাবাজি-নৈরাজ্য করা যাবে না। এসব ঘটনায় যাদের জড়িত থাকার খবর পাওয়া গেছে তাদের পার্টি থেকে এরই মধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে। এসব অপকর্মে যারাই জড়িত থাকবে তাদের আইনের হাতে তুলে দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সে যে-ই হোক না কেন।’
বিএনপির নানামুখী পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ দেশে আওয়ামী লীগের মতো চাঁদাবাজি, মাস্তানি ও দখলের রাজনীতি আর চলবে না। আওয়ামী লীগকে বিদায় করে যদি এগুলো আমরা বন্ধ করতে না পারি, তাহলে লাভটা কী হলো?’
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশে লুটপাটসহ নানা নেতিবাচক ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষেত্রেই বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব অপকর্মের অভিযোগ ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সারা দেশে টিম গঠন করে জনগণ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে থাকার নির্দেশনা দেয় বিএনপি। নির্দেশনা অনুযায়ী, বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দল এবং দলপন্থি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের নেতাকর্মীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে পাহারা বসায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে। দলটির নেতারা বলছেন, যে কোনো মূল্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে তারা বদ্ধপরিকর।
জানা গেছে, নানা অপকর্মে জড়িত থাকার দায়ে এরই মধ্যে দল ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তাদের মধ্যে যুবদলের অন্তত ৩১ জন, স্বেচ্ছাসেবক দলের ১৫ জন রয়েছেন। এ ছাড়া ৫০ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান ও পদ স্থগিত করা হয়েছে। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাশিমও রয়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) বিলকিস জাহান শিরিনের পদও স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে ২৪ ঘণ্টার সময় দিয়ে শোকজ করা হয়েছে।
দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিএনপি কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একই ধরনের বার্তা দিয়েছেন। তাদের নির্দেশনা মেনে এখন পর্যন্ত ২১৭ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একজন সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ স্থগিত করা হয়েছে। চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি, যেন দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। আমরা শান্তি-সম্প্রীতির বাংলাদেশ চাই।’
সম্প্রীতি রক্ষা এবং নৈরাজ্য বন্ধে ঢাকা মহানগর উত্তরের থানা-ওয়ার্ডে নেতাকর্মীদের নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভা করছেন মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘কিছু দুষ্কৃতকারী, কিছু নব্য বিএনপি দলের নাম ভাঙিয়ে বদনাম ছড়ানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই লোকগুলোই লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। কেউ যাতে এ ধরনের কাজ করতে না পারে সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আর দলের কেউ এ কাজ করার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তুলে দিতে হবে। কেননা চাঁদাবাজি, দখলদারি, লুটতরাজের বিরুদ্ধে বিএনপির নীতি জিরো টলারেন্স।’
দেশে সম্প্রীতি রক্ষায় দলের এমন কঠোর অবস্থানকে স্বাগত জানাচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে কেউ কেউ বড় অপকর্ম করেও পার পেয়েছেন বলে অভিযোগ তাদের। খোদ রাজধানীতেই নৈরাজ্য সৃষ্টি করেও দু-একজন ছাড় পেয়ে গেছেন বলেও তারা জানিয়েছেন। এ ঘটনায় ‘নেতাদের মুখ দেখে’ সাংগঠনিক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে সারা দেশে নেতাকর্মীদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে বলে দাবি অনেকের। এতে করে তৃণমূল পর্যায়ে সুযোগসন্ধানীরা অপকর্মের সুযোগ নিচ্ছে বলে অভিমত তাদের। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোনো অনুপ্রবেশকারী যাতে বিএনপিতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে সারা দেশের নেতাকর্মীদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলের কেউ এ নির্দেশনা অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
এদিকে হাইকমান্ডের নির্দেশে চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব বন্ধ এবং সম্প্রীতি রক্ষা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও দলের ‘ক্ষুব্ধ’ নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হচ্ছেন খোদ বিএনপির নেতারাই। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায়। স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী লিয়াকতের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তবে ভাঙচুরকারীদের বিরুদ্ধে দল থেকে এখনো কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।