সানাউল হক সানী
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:০৭ এএম
আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নিয়মনীতি উপেক্ষা

মধুময় কৃষির প্রকল্পে পছন্দের সব পিডি

মধুময় কৃষির প্রকল্পে পছন্দের সব পিডি

কৃষি মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রকল্প ‘প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেসিলেন্স (পার্টনার)। মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ৭টি সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প। এর মধ্যে ৭৬০ কোটি টাকার কাজ করছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তবে এই প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে মৎস্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে। যদিও ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালক বিসিএস কৃষি ক্যাডারের কর্মকর্তা হবেন। শুধু এই প্রকল্পই নয়, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পেতে আগ্রহের কমতি নেই অনেক কর্মকর্তার। আর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের মধ্যে থেকে পছন্দমতো প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, তেমনি কাজের মান নিয়েও দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন।

জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি গত ২৪ আগস্ট একনেকে পাস হয়। প্রায় ৪০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ে তিনজনের নাম প্রস্তাব করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে তালিকায় তালহা জুবাইর মাসরুর নামে এক কর্মকর্তার জন্য বিশেষভাবে সুপারিশ করেছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে একজনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করার বিধান নেই।

জানা গেছে, প্রকল্পটির প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরির সময় ফোকাল পারসন ছিলেন তালহা জুবাইর। প্রকল্পের অনুমোদিত অঙ্গ ও অঙ্গভিত্তিক বিস্তারিত ব্যয়ের খাতে নানা অসংগতি রয়েছে। প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি স্থাপন হলেও তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অন্য কেনাকাটায়। অনেক ক্ষেত্রে কেনাকাটার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মূল্য ধরা হয়েছে।

প্রকল্পের কাগজপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ রেখেছেন ফোকাল পারসন। এর মধ্যে বাড়িভাড়া খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ৫১ লাখ টাকা। আবার আবাসিক ভবন মেরামতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা। অনাবাসিক ভবন মেরামতে বরাদ্দ ২ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের জন্য ৭টি মোটরসাইকেল কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের জন্য ইন্টারনেট বিল ধরা হয়েছে ৩ লাখ টাকা। টেলিফোন বিল ১ লাখ এবং আলাদাভাবে আবার মোবাইল বিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ডাক খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছে ১ লাখ টাকা। প্রচার ও বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ লাখ, আবার অডিও এবং ভিডিও ডকুমেন্টেশনে খরচ ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। প্রকাশনা খাতে খরচ ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রচার-প্রচারণা খাতকে নানা ভাগে নাম দিয়ে খরচ বাড়ানো হয়েছে।

আবার প্রশিক্ষণ খাতেও বিপুল ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কৃষক প্রশিক্ষণ (উত্তম চর্চা) বাবদ ৫ কোটি ৪৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, কৃষক/গার্ডেনার/মালি প্রশিক্ষণ বাবদ আবার ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। টিস্যু কালচার স্টাফ প্রশিক্ষণ বাবদ ৪ লাখ ৯ হাজার, এসএএও প্রশিক্ষণ বাবদ ১৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাবদ ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। জাতীয় কর্মশালা বাবদ ৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অগ্রগতি (প্রগ্রেস) মনিটরিং করার জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। আবার মধ্যবর্তী মূল্যায়নের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভ্রমণ ব্যয় হিসেবেও ধরা হয়েছে ৯০ লাখ টাকা।

শুধু স্ট্যাম্প ও সিল বানানোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। আবার স্টেশনারি কেনা বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, টিস্যু কালচার প্রকল্পের কাজ হলেও ল্যাবরেটরি এবং আনুষঙ্গিক গবেষণায় ব্যয় না রেখে ভবন নির্মাণ এবং অন্য ব্যয়ের দিকে নজর বেশি বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, একই ধরনের কাজের জন্য আলাদা আলাদা নামে বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

তারা জানান, তালহা জুবায়ের কখনো হর্টিকালচার উইংয়ে কাজ করেননি। তিনি চুয়াডাঙ্গায় কৃষি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদন’ প্রকল্পের মনিটরিং অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। হর্টি কালচার উইংয়ের সাবেক পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম এ প্রকল্পের ফোকাল পারসন ছিলেন। তবে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তালহা জুবায়েরকে ফোকাল পারসন করা হয়। তিনি আগের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে নতুনভাবে প্রকল্প তৈরি করেন। যদিও ড. সাইফুল ইসলাম হর্টি কালচার উইংয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত উপপরিচালককে ফোকাল পারসন করার প্রস্তাব করেছিলেন।

এদিকে তালহা জুবায়েরের বিরুদ্ধে ইউটিউব এবং ফেসবুকে ভিডিওতে কৃষির নানা কন্টেন্ট তৈরি করে কৃষকদের ধোকা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কমলা, নারিকেল, মাল্টাসহ নানা ফলের চারা বিদেশি উচ্চফলনশীল বলে প্রচার করতেন। তবে এর আড়ালে নিজেই করতেন চারার ব্যবসা। আর সেই মানহীন চারায় নিঃস্ব হয়েছেন অনেক কৃষক।

‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্প নামে আরেকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. মেহেদী মাসুদ। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ড. মেহেদী মাসুদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। তবে এর পরও তাকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন প্রকল্পে মন্ত্রণালয়ের অনেক সুবিধাভোগী রয়েছেন। তারা নিজেদের পছন্দসই লোককে বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে রাখতে চান। ড. মেহেদী মাসুদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও সেই প্রক্রিয়ার অংশ। ওই প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেক কর্মকর্তা থাকলেও তাদের দায়িত্ব না দিয়ে ড. মেহেদী মাসুদের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

পার্টনার প্রকল্পের বিপণন অঙ্গের ৭৬০ কোটি টাকার প্রকল্পের পরিচালক বানানো হয়েছে মৎস্য ক্যাডারের কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ফারুককে। যদিও প্রকল্পের ডিপিপিতে বিসিএস কৃষি ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তাকে ওই দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প পরিচালনার অভিজ্ঞতা অথবা বৈদেশিক মাস্টার্স/পিএইচডি থাকতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালকের যোগ্যতা হিসেবে সরকারি চাকরির মেয়াদ সাত বছর থাকতে হবে, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বা প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত উন্নত প্রশিক্ষণ এবং প্রকল্প প্রস্তুতকরণ টিমের সদস্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ফারুকের চাকরির মেয়াদ থাকা ছাড়া অন্য যোগ্যতা নেই।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথি ঘেঁটে দেখা যায়, প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রাথমিকভাবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করলে মন্ত্রণালয় থেকে তা খারিজ করে ডিপিপি অনুযায়ী নতুন তিনজনের নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম ফের ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ফারুকের নাম প্রস্তাব করেন। এর সঙ্গে যুক্ত করে দেন আগে বাদ যাওয়া তিনজনের মধ্যে দুজনের নাম। ফলে মন্ত্রণালয় মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ফারুককেই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেয়।

জানা যায়, বিসিএস ২১তম ব্যাচের মৎস্য ক্যাডারের এ কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে চলতি বছরের শুরুতেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে যোগদান করেন। যোগদানের পরপরই তাকে ১৭০ কোটি টাকার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগেই নিয়ম লঙ্ঘন করে তাকে দেওয়া হয় ৭৬০ কোটি টাকা বাজেটের নতুন প্রকল্পের দায়িত্ব।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যেটা ভালো হবে, আমরা নিয়মের মধ্যে সেটাই করি। দেখেশুনে ভেবেচিন্তে প্রকল্প পরিচালক করা হচ্ছে। যদি আমরা দেখি যে, তারা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না, তখন পরিবর্তন করে দেওয়া হবে। সার্বিক বিষয়ে আমরা খেয়াল রাখছি।’ তিনি বলেন, ‘যারা প্রকল্প পরিচালক হতে চেয়েছেন, হতে পারেননি তারাই এসব বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আট বউ নিয়ে প্রকাশ্যে মোশাররফ করিম

বিশ্বকে প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’ দেখাল ভারত-পাকিস্তান

টাইগারদের বোলিং কোচ অ্যাডামসের বিদায়, নতুন কোচ হচ্ছেন টেইট

আ.লীগের নিবন্ধন দ্রুত বাতিল করতে হবে, ইসিকে নাহিদ

দেশেজুড়ে কবে হতে পারে বৃষ্টি জানাল আবহাওয়া অফিস

বিকেলে জুলাই ঐক্য’র জরুরি বৈঠক, আসতে পারে নতুন সিদ্ধান্ত

রাজনৈতিক দলের বিচারে ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন, গেজেট প্রকাশ

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন জুলাই যোদ্ধা দুর্জয়

চাঁদা না পেয়ে শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা

মেসির গোলের পরও মায়ামির বড় পরাজয়

১০

নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনো কার্যক্রম ঢাকায় চলবে না : ডিআইজি রেজা 

১১

ছোট ভাইয়ের বাসায় ৪ ঘণ্টা কাটালেন খালেদা জিয়া

১২

পিনাকী-ইলিয়াস-কনকের ইউটিউব চ্যানেল ব্লক করল ভারত

১৩

আমরা কোনো প্রতিকূল আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আশা করি না : প্রেস সচিব

১৪

সীমান্তে পুশ ইন ঠেকাতে সতর্ক বিজিবি, নিরাপত্তা জোরদার

১৫

খরায় বীজতলা ফেটে চৌচির, দুশ্চিন্তায় কৃষক

১৬

নাম্বার ওয়ান বিটিএস

১৭

বিস্ফোরক মামলায় আ.লীগ নেতা কিশোর গ্রেপ্তার 

১৮

আ.লীগের নিবন্ধন নিয়ে সিদ্ধান্ত কবে, জানালেন সিইসি

১৯

বটগাছের ডাল কাটা নিয়ে যুবককে কুপিয়ে হত্যা

২০
X